গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর: কোটালীপাড়া, কাশিয়ানী,
টুঙ্গীপাড়া ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় ঐতিহ্যবাহী
গ্রামীন শিল্প হোগলা পাতা দিয়ে চাটাই, অন্যান্য
শৌখিন সামগ্রী তৈরি করে গোপালগঞ্জ জেলার ১০ হাজার
নারী আত্মনির্ভশীলতার পথে হাটছেন। গোপালগঞ্জ জেলার
কোটালীপাড়া, টুঙ্গীপাড়া, কাশিয়ানী, মোকসুদপুর ও সদর
উপজেলার বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে হোগলা
শিল্প। নি¤œ আয়ের নারীরা এই শিল্পের সাথে সরাসরি
জড়িত। মাত্র ১০০ টাকার হোগলার পাতায় ৩টি ৩০০ টাকা
মূল্যের চাটাই বোনা যায়। একজন নারী ঘরে বসেই দক্ষ
হাতে প্রতিদিন ৩/৪ টা চাটাই বুনতে পারেন।মতাই এ
অঞ্চলের নারীরা খুব সামান্য পুজি নিয়ে এ কাজটি করে
যাচ্ছেন। হোগলা শিল্প কে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে
সাপ্তাহিক হাট। এই হাট থেকে ঢাকা , চট্রগ্রাম,
সিলেট, রাজশাহী খুলনা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, বরিশাল,
যশোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বছরে কয়েক কোটি
টাকার হোগলা শিল্প চালান করা হয়। শুধু দেশেই নয়
আন্তর্জাতিক বাজারেও পরিবেশ বান্ধব হোগলা শিল্প
রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার
সম্ভাবনা রয়েছে।
গোপালগঞ্জ জেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়,
গোপালগঞ্জ জেলায় ১০ হাজার হেক্টরের বেশী জমিতে হোগলা
পাতা চাষ হয়। এটি তৃন জাতীয় উদ্ভিদ এ গাছটি
লম্বা ১৫ থেকে ২০ ফুট হয়ে থাকে। গোপালগঞ্জ জেলার বিল
গুলোতে পলিমাটি সমৃদ্ধ হওয়ায় এসব জমিতে হোগলা
গাছ প্রকৃত ভাবেই বংশ বিস্তার করে। খরা বা বর্ষায় এ
গাছের কোন ক্ষতি হয় না। যে কোন পরিবেশে গাছটি
দীর্ঘজীবি। তাই এই এলাকার মানুষেরা প্রায় বিনাশ্রমে
হোগলা গাছ পেয়ে থাকে। যার ফলে এখানে হোগলা পাতার
শিল্প প্রসার লাভ করেছে। এ শিল্পটি নারী শ্রমিকদের ওপর
নির্ভশীল। এই এলাকায় নিন্ম শ্রেনীর আয়ের লোকেদের
প্রায় নারীরা এ কাজে জড়িত। এদিকে হোগলাপাতা শিল্প
শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে জেলার বিভিন্ন স্থানে
হোগলা পাতা বিক্রির পাইকারী বাজার। সে হাটের বিরাট
একটি স্থান জুড়ে রয়েছে শুধু হোগলা পাতা বেচা-কেনার
স্থান। এই হাটে হোগলাপাতা বেচা কেনা করে কয়েক
শ্রেনীর মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন। তাদের একদল
মাঠে গিয়ে গৃহস্থ কৃষকদের কাছ থেকে হোগলাপাতা
সংগ্রহ করেন। সে পাতা দিয়ে আটি বাধা হয়। পাতার মান
অনুযায়ী আলাদা আলাদা করে আটি বাধা হয়। হোগলা
পাতার মান অনুয়ায়ী প্রতিটি আটির দাম হেরফের হয়।
এখান থেকে হোগলা পাতা কিনে সে গুলো চাটাই তৈরি
করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামীণ নারীদের কাছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলার প্রতিটি
হোগলা পাতা হাটে এখান থেকে প্রায় ১০ থেকে ২০ লক্ষ
টাকার চাটাই দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয়। এ
নিয়ে সঠিক কোন পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারনা করা হয়
বছরে জেলার হাট গুলোতে কয়েক কোটি টাকার ওপরে
হোগলা পাতার সামগ্রী বেচা-কেনা হয়।
একটি সুত্রে জানা যায়, গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া
উপজেলার প্রত্যান্ত কয়েকটি গ্রামে হোগলা শিল্পের কেন্দ্র
বিন্দু। এখানে পর্যাক্রমে এ শিল্পের বিকাশ ঘটছে।
গ্রামের প্রত্যান্ত অঞ্চলের নিন্মবিত্ত পরিবারের নারীরা এ
চাটাই শিল্পের ধারক ও বাহক। দৈনন্দিন সাংসারিক কাজের
পর বেচে যাওয়া সময় টুকু কে তারা ব্যয় করেন চাটাই
বুননের কাজ করেন। চাটাই তৈরির কাজ খুব একটা কঠিন
না হলে ও বেশ পরিশ্রমের ও সময় সাপেক্ষেও। এ নারীরা ঘর
সংসার সামলানোর পরও পরিবারের বাড়তি কিছুর রোজগারের
প্রত্যাশায় হোগলা পাতার নান্দনিক রূপ দিয়ে তৈরি করে
চাটাই শিল্প। এখানকার নারীরা তাদের পুর্বপুরুষ থেকে
প্রাপ্ত পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে প্রতি নিয়ত যুদ্ধ করে
যাচ্ছে। কোন রকম প্রশিক্ষন ছাড়াই তারা কাজ গুলো
শিখেছেন বংশ পরস্পরায় ।
বাজার ব্যবস্থা : হোগলা দিয়ে উৎপাদিত সাধারনত অভ্যন্তরীন
বাজারেই সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে বিদেশের বাজারেও
হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি উচ্চ মানের হস্ত শিল্পের চহিদা
রয়েছে বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এর প্রসার এখনও
তেমন ঘটেনি। দু’একটি প্রতিষ্ঠান এ ধরনের পন্য তৈরি
করে রফতানি করছে।
ফড়িয়াদের দৌড়াত্ব : ফড়িয়া স্থানীয় ভাষায় যারা দালাল
নামে পরিচিত চাটাই শিল্পের সঙ্গে জড়িত একজন নারী
হোগলা পাতা কেনা থেকে শুরু করে যে পরিমান কায়িক
শ্রম দিয়ে একটি চাটাই তৈরি করেন এ ফড়িয়াদের
কারনে তারা তাদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। একটা
চাটাই তৈরি করতে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ টাকার পাতা
কিনতে হয়। তার সঙ্গে আছে তৈরি করা পর্যন্ত পুরো
একটি দিনের শ্রম। শ্রমের বাজারে যার মূল্য সর্বনি¤œ
১৫০ টাকা কিন্তু দেখা যায় তৈরিকৃত একটি চাটাই
যখন বাজারে আসে তখন ফড়িয়ারা এর দাম ধরে ১০০ টাকা।
এ অবস্থায় কারিগররা অর্থনৈতিক টানা পড়নের কষাঘাতে
জর্জরিত হয়ে এ সমস্যা গুলোকে স্বীকার করে নিচ্ছেন।
পক্ষান্তরে লাভবান হচ্ছে ফড়িয়ারা তারা চাটাই শিল্পর নারীদেও
অসহায়ক পুজি করে যুগ যুগ ধরে নিজেদের অর্থনৈতিক
সম্মৃদ্ধি করে তুলছে।
সমস্যা : যুগ যুগ ধরে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত থেকেও এই
অঞ্চলের নারীরা তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন
করতে পারেনি। অনেক নারী ঋনের বেড়া জালে আবদ্ধ হয়ে
মানবেতর জীবন যাপন করছে। ঋণ এবং অনুদান সর্বদা এদের
আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই দরিদ্র নারীদের আর্থসামাজিক
জীবন ক্ষুদ্র গতির মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে আছে। অথচ এ শিল্পকে
কেন্দ্র করেই নারীদের মধ্যে নিহিত রয়েছে এক সাধারন পথ।
উজ্জ্বল সম্ভাবনা : সব কিছুর পরও হোগলা শিল্পর এক উজ্জ্বল
সম্ভাবনা রয়েছে। তবে প্রচারের অভাবে এটি তেমন
বিকাশ লাভ করতে পারেনি। এই শিল্প থেকে উৎপাদিত ছোট
বিছানা, নামাজের মাদুর, মাদুর, ছোট ব্যাগ, টুরকি,
গোলটুপি, ঘরে নানা ধরনের ওয়ালম্যাট, এল্টিং হাতপাখা
ইত্যাদি পন্য অপেক্ষাকৃত কম দামে পাওয়া যায় বলে দেশ ও
বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সব মিলিয়ে এই শিল্পের
রয়েছে উজ্জ্বল সম্ভাবনা।
প্রয়োজন দক্ষ প্রশিক্ষণ : হোগলা শিল্পের সঙ্গে জড়িত
নারীরা চাটাই বা অন্যান্য সামগ্রী তৈরিতে অত্যন্ত দক্ষ।
এর জন্য তারা কোন প্রশিক্ষন পাননি। বংশ পরস্পরায় তারা এ
কাজে দক্ষতা অর্জন করেছেন তবে সামান্য প্রশিক্ষন পেলে এ
নারীরা বিভিন্ন শৌখিন সামগ্রী তৈরিতে আরও দক্ষ হয়ে
উঠবে। আর আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলো রফতানি করে
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।