‘জঙ্গি ও সন্ত্রাসী আছে, মনে মনে এমন ভয় ছিল। এসে দেখি সে ভয় নেই।
বাংলাদেশ অনেরক ভালো, বিশ্বের যে কোনো দেশের মানুষের চেয়ে
আতিথেয়তায় সেরা। ভালোবাসার টানে নিজের মাতৃভূমি
ছেড়েছি।’এসব কথা বলেন ভালোবাসার টানে বাংলাদেশে ছুটে আসা
মার্কিন তরুণী এলিজাবেথ এসলিক (২০)।
এলিজাবেথের বাড়ি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের ওরিয়েন্ট এলাকায়। আর
এখন আছেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার রাখালগাছী গ্রামে স্বামী
মিঠুন বিশ্বাসের (২৪) বাড়িতে। ভৌগোলিক দূরত্ব বাধা হতে পারেনি।
প্রায় ১৩ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ভালোবাসার মানুষের কাছে
ছুটে এসেছেন তিনি। খ্রিস্টান ধর্মের বিধান অনুযায়ী বিবাহবন্ধনে
আবদ্ধ হয়েছেন এলিজাবেথ। মিঠুনের পরিবারও একই ধর্মের অনুসারী। গত ৯
জানুয়ারি খুলনার একটি গির্জায় বিয়ে হয়েছে তাঁদের। বিয়ে পড়ান
রেভারেন্ড লিতু মুন্সী।
গত ২ জানুয়ারি বাংলাদেশে পা রাখা এলিজাবেথ বলেন, ‘সত্য ভালোবাসা
সীমানা মানে না। মানে না জাত, ধর্ম, বর্ণ। ভালোবাসার জন্য মরণও
আনন্দের। প্রেম মানুষকে মহান করে তোলে। সত্যিকারের মানুষ হতে শিক্ষা
দেয়।’ তাঁর ভাষায়, এটা তাঁর স্বামীর দেশ। ভালোবাসার বাংলাদেশ।
ওয়াশিংটনে থাকেন এলিজাবেথের বাবা রয় এসলিক ও মা সনিয়া এসলিক।
তাঁর দুই ভাই আছে। সবে স্নাতক শেষ করেছেন এলিজাবেথ। ১৯৯৭ সালের ৭
জুলাই জন্ম তাঁর।
মিঠুন একটি এনজিওতে কাজ করেন। এর আগে দেড় বছর সিঙ্গাপুরে
ছিলেন তিনি। এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। কেবল রাখালগাছী
গ্রামের মানুষ নয়, দূর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা অঞ্চলে এ বিয়ের খবর।
মিঠুনের বাড়িতে প্রতিদিন ভিড় করছেন শত শত মানুষ। তাঁদের সঙ্গে
হাসিমুখে কথা বলছেন নবদম্পতি।
২০১৫ সালের মে মাসে ফেসবুকের মাধ্যমে মিঠুন ও এলিজাবেথের পরিচয়
হয়। সেই থেকে চলে প্রেম নিবেদন। বাংলাদেশ আর যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক
দূরত্ব ঘুচিয়ে প্রেমের সাগরে ডুবে যুগলবন্দি হয়েছেন তাঁরা। মিঠুন
বিশ্বাস বলেন, ‘আড়াই বছরের সম্পর্কের পর আমরা সিদ্ধান্ত নিই বিয়ে
করার। দুজনের পরিবারকেও সেটা জানাই। এতে আমার পরিবার কোনো আপত্তি
না জানালেও এলিজাবেথের পরিবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’
মিঠুনের সঙ্গে পরিচয়ের আগে এলিজাবেথ বাংলাদেশ বলে কোনো দেশ
আছে তা জানতেন না। এলিজাবেথের পরিবার বাংলাদেশকে উগ্রপন্থী
মুসলিম দেশ বলে মনে করে আসছিল। বাংলাদেশে গেলে তাঁকে মেরে ফেলা
হবে, এমন ভয়ভীতিও দেখায় পরিবার। পরিবারের বাধা অগ্রাহ্য করে প্রেমিকের
কাছে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন এলিজাবেথ। সুন্দর সবুজে ঘেরা এ দেশ
তাঁকে মুগ্ধ করে। ভালোবাসা তাঁকে আরো আঁকড়ে ধরে। শ্বশুর, শাশুড়ি,
আত্মীয়স্বজনকে কাছে পেয়ে ভুলে গেছেন সব কিছু।
এলিজাবেথ এসলিক বলেন, ‘আমার ইচ্ছা মিঠুনের সঙ্গে থাকার।
আমেরিকায় গেলে দুজনে একসঙ্গেই যাব। আর এখানে থাকলে একসঙ্গেই
থাকব। আমি একা মিঠুনকে রেখে যাব না। আর যদি আমি একা যাই,
তাহলে আমার লাশ যাবে। আমরা দুজনেই ভিসার জন্য আবেদন করেছি। বাবা-
মাকে ছাড়া এখানে থাকতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সম্পর্কে বাবা-মা আমাকে যে ভুল ধারণা
দিয়েছিলেন, এখানে এসে তেমন কিছুই আমি পাইনি। পৃথিবীর সেরা
অতিথিপরায়ণ দেশ এটি। এখানকার মানুষ ধর্ম-বর্ণ আলাদা করে দেখে না।
ভালো মানুষের ছড়াছড়ি।’ এলিজাবেথ বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করেছেন। এরই
মধ্যে বাংলায় মা ও বাবা ডাকতে শিখেছেন।
নববধূ আরো জানান, প্রেমে পরিবারের বাধা পেয়ে তিনি হতাশ হয়ে
পড়েছিলেন। কিছুদিনের চেষ্টায় তিনি তাঁর দেশের ওয়ালমার্ট
কোম্পানিতে চাকরি পান। টাকা জমানোর জন্য কয়েক মাস চাকরিও করেন।
সেই টাকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ছেড়ে বাংলাদেশের ভালোবাসার মানুষের কাছে
ছুটে চলে আসেন। এলিজাবেথের পরিবারের এখন সবাই খুশি।
কালীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ৯ কিলোমিটারের পথ মিঠুনের বাড়ি। মার্কিন
বধূ পেয়ে মিঠুনের পরিবারের সদস্যরা খুশি। বাবা নির্মল বিশ্বাস বলেন,
‘ছেলের সুখের কথা চিন্তা করে সব কিছুই মেনে নিয়েছি। বউমা লক্ষ্মী।
অন্য সব বাঙালি মেয়েদের মতো করে সব কিছু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা
করছে সে।’
মিঠুনের মা মায়া বিশ্বাসও বিদেশি বউমা পেয়ে খুশি। ছেলের বউ যেন
সুখে থাকে এর জন্য দোয়া চেয়েছেন। কেউ এলে তাঁর সঙ্গে নতুন বউকে
পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। রাখালগাছী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহিদুল ইসলাম
মন্টু বলেন, বিদেশি অতিথির নিরাপত্তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া
হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন ও গ্রামের লোকজন সব সময় এলিজাবেথের নিরাপত্তা
দিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। ইউনিয়নবাসী নতুন বউয়ের জন্য গর্বিত
বলেও জানান তিনি।
এলিজাবেথ-মিঠুনের প্রেম যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের নতুন
সেতুবন্ধ তৈরি করবে এমন প্রত্যাশা এ অঞ্চলের মানুষের।
স্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহঃ