ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ
কথাটা বলছিলেন ৫০ ঊর্ধ রাহাতুন্নেছা।যদিও ওনাকে দেখে ৭০বছর বয়সী
মনে হচ্ছিল। স্বামীকে নিয়ে ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুরে একটি ঘর ভাড়া করে
থাকেন তিনি। ঘর ভাড়া এবং বিদ্যুৎ বিল সহ মোট ভাড়া প্রতি মাসে ৭০০
টাকা। কথা বলাতে ওনার একটু সমস্যা আছে। আমাদের মত স্বাভাবিক ভাবে
কথা বলতে পারেন না তিনি। স্বামী কে নিয়ে চা খেতে এসেছিলেন
পুরানো ডি.সি. কোর্টের ২য় গেইট এর চা দোকানে। সেখানেই কথা
হয় ওনার সাথে। সাথে ছিল কিছু ভর্তি একটা মোটা বস্তা। সেটা দেয়ালের
পাশে রেখে বসলেন বেঞ্চে।
কিছুক্ষণ পর চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলতে লাগলেন, বেশ ছোট বেলায় বাবা
মা মারা গেছে। বাবার নাম খোদা বক্স। চাকরি করতেন পোষ্ট অফিসে।
পৈতৃক সম্পত্তির যে ভাগ পেয়েছিলেন তা নিয়ে নিয়েছে এবং তা
বেঁচেও দিয়েছেন। একটা তিন তলা বিল্ডিংও নাকি ছিল তাদের। সেটা এখন
অন্য কারো। মন দিয়ে শুনছিলাম তার কথা। জিজ্ঞাসা করলাম যে কিছু খাবেন
কি না ? উত্তরে বললেন যে দুপুরে ঝাল দিয়ে ভাত খেয়ে বের হয়েছেন। এখন আর
কিছু খাবেন না। ছেলে মেয়ে নেই তাদের।
জানতে চাইলাম ্য়ঁড়ঃ;ঘর ভাড়া আর খাওয়ার খরচ কি ভাবে চলে ? ্য়ঁড়ঃ;বললেন ্য়ঁড়ঃ;আমি ভালো
ঘরের মেয়ে। আমার আব্বা ডাকঘরে চাকরি করত। খুব কষ্ট হয় দুদজনার চলতি।
ঝিনাইদহ শহরের বিভিন্ন স্থানে প্লাষ্টিকের খালি বোতল খুটে বেঁচি। দাম
তেমন একটা ভাল পায় না “খুব কষ্টে বেচেঁ আছি, তাও আমি ভিক্ষে
করিনে-ভিক্ষে করবও না” !
কথা গুলো শুনে বিস্মিত হলাম। কি পরিমাণ আত্ম মর্যাদা এবং দৃঢ প্রতিজ্ঞ
হলে এই রকম চরমতম দারিদ্রতার সামনে দাড়িয়ে এরকম কথা বলা এবং কাজ করা
দুদটোই সম্ভব ? তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে বাসা কোথায় এবং
কয় ভাই বোন। আমিও উত্তর দিলাম উনার কথায়।তারপর দেখালেন যে তার বাম
পায়ে কাপড় দিয়ে পেঁচানো। বললেন পা ভাঙা। ঠিক মত হাঁটতেও পারেন না।
খুব কষ্ট হয়। বললেন, স্বামীর নাম আব্দুর রব। তার নিজের বাড়ি বরিশাল। তার
জমিও ভোগ দখল করছে সেখানে তার ভায়েরা।
তারপর উঠে চায়ের দাম দিতে গেলে আমি বললাম যে আমি দিব, আপনি
রাখেন। উনি রাজি হলেন না। পরে অনেক অনুরোধ করার পর রাজি হলেন। তারপর
তিনি আর তার স্বামী উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বিদায় জানিয়ে বস্তাটা তুলে
নিয়ে চলে যেতে লাগলেন। দেখলাম ঠিকমত হাঁটতে পারছেন না। দেখলাম ধীরে
ধীরে চলে যাচ্ছেন, যাচ্ছেন আরও একটা দিন বেঁচে থাকার যুদ্ধে।
দীর্ঘশ্বাঃস বের হল। তবে ওনার দৃঢ়তা দেখে সত্যিই অভিভূত হলাম।
একটু খেয়াল করে দেখেন একজন সাদা শাড়ি পড়া বৃদ্ধা মহিলা বসে চা
খাচ্ছেন।এবার ওনার গল্প বলি।।ঝিনাইদহ শহরের চাকলা পাড়ায় একজনের বাসায়
থাকেন কোন মতে। কিন্তু যার কাছে থাকেন তিনিও থাকেন বাসা ভাড়া করে।
এখন তিনিও রাখতে চাচ্ছেন না। বলে দিয়েছেন থাকতে হলে ভাড়া দিতে হবে।
এ শহরে কেউ নেই তার। তবে কোন একটা জায়গায় যেন তার মেয়ের বিয়ে
হয়েছে বলে জানালেন।
মেয়ের বাড়িতে থাকছেন না কেন জিজ্ঞাসা করায় তিনি জানালেন যে তার
জামাই মানে মেয়ের বর খুবই খারাপ। তাকে থাকতে দেন না।।এক কাপ চা আর
একটা নরম বিস্কিট খেতে চাইলেন। ওনাকে দেওয়া হল চা, বিস্কিট আর
একটা পাওরুটি।হঠাৎ বললেন ্য়ঁড়ঃ;টাকা নেই। থাকলি কবে চলে যাতাম। ্য়ঁড়ঃ;আগ্রহী
হয়ে প্রশ্ন করলাম যে কোথায় যেতেন ?
উনি বলতে লাগলেন, ওনার বাড়ি ভারতের কল্যানী নামক স্থানে। সেখান থেকে
তিন বছর আগে এ দেশে এসেছিলেন মেয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানে মাত্র
কয়েক দিনই জায়গা পেয়েছিলেন। ভারতে তার বাড়ি আছে। একটা ছেলে
আছে। ওনার ভাষ্যমতে ছেলেটা নাকি পাগল মত কিছুটা। পায়ের উপর দিয়ে
ট্যাক্সি জাতীয় কোন গাড়ি চলে গেছে। কিন্তু তার চিকিৎসা করা তো দূরের
কথা, ভারতে যাওয়ার টাকাও নেই তার।তিনিও চা শেষ করে চলে গেলেন।।শুধু
থেকে গেল কিছু গল্প। প্রতিনিয়ত জীবন যুদ্ধের কিছু সৈনিকের গল্প।
কিছু হার না মানার গল্প।