মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১৭ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

হাতিরঝিল লেকে লাশের কাছে ভাসছিল এক টুকরা কাগজ, তাতেই ধরা ‘খুনিরা’

অনলাইন ডেস্
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২০
  • ২০৬ বার পড়া হয়েছে

রাজধানীর হাতিরঝিল লেকে গত সোমবার ভোরে ভাসছিল অজ্ঞাত এক যুবকের গলিত লাশ। লাশের আনুমানিক ৫০ মিটার দূরে লেকের কিনারে তখন ভাসছিল একটি ছেঁড়া কাগজও। সেখানে লেখা একটি মুঠোফোন নম্বরের সূত্র ধরে অজ্ঞাত ব্যক্তির পরিচয় এবং তাকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। জানা যায়, তিনটি পাসপোর্ট সংশোধনের জন্য দেওয়া দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা ফেরত চাওয়ায় ওই যুবককে পরিকল্পিতভাবে তার বাল্যবন্ধু হত্যা করেন। এই কাজে তাকে সহায়তা করেন আরও তিনজন।

পুলিশ সূত্র জানায়, লাশটি পচে-গলে গিয়েছিল। তাই এটি কার লাশ তা চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না। আঙুলের ছাপও নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু কিন্তু ওই ছেঁড়া কাগজটিতে একটি ফোন নম্বরও লেখা ছিল। ফোন নম্বরটির সঙ্গে কাদের কথা হয়েছে, কখন কথা হয়েছে এমন বেশ কিছু বিষয়টি চিহ্নিত করে কয়েক ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরপর গ্রেপ্তার করে পুরো খুনের বিষয়টি জানা যায়।

নিহত ওই যুবকের নাম আজিজুল ইসলাম (২৪)। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন। আমেরিকা প্রবাসী বাবার একমাত্র ছেলে তিনি। তার জন্ম চট্টগ্রামের সন্দীপের বাউরিয়া গ্রামে। মাকে নিয়ে থাকতেন চট্টগ্রামের ফিরোজ শাহ এলাকায়। পড়ালেখা শেষে তার কানাডা যাওয়ার কথা ছিল। পরিচিতজনদের পাসপোর্ট ও ভিসা প্রসেসিং এ সহায়তা করতেন তিনি।

তাঁকে হত্যার অভিযোগ গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন, গুলশানের দ্যা গ্রোভ রেস্টুরেন্টের এক্সিকিউটিভ শেফ মো. আহসান উল্লাহ (৩০), ওই রেস্টুরেন্টের কর্মচারী মো. তামিম ইসলাম (২৭), পাসপোর্ট অফিসের দালাল মো. আলাউদ্দিন (৪৬) এবং যে গাড়িতে করে আজিজুলের লাশ হাতিরঝিলে এনে ফেলা হয় সেই গাড়ির চালক আবদুর রহিম। আজিজুলের লাশ উদ্ধার করা হয় সোমবার সকালে। আর মঙ্গলবার রাতে এই চারজনকে খিলক্ষেতের উত্তরপাড়া ও হাতিরঝিলের মহানগর আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার আহসান গতকাল বুধবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বাকি তিনজনকে দুই দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

আলামতসহ গ্রেপ্তার ৪ আসামি। বাম থেকে আলাউদ্দিন, রহিম, তামিম ও আহসান।

আলামতসহ গ্রেপ্তার ৪ আসামি। বাম থেকে আলাউদ্দিন, রহিম, তামিম ও আহসান।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেলে আর্থিক সংকটে পড়েন আহসান উল্লাহ। তিনি তখন তার স্ত্রীর আত্মীয় আলাউদ্দীনের কাছে কিছু টাকা ধার চান। আলাউদ্দিন তাকে টাকা ধার না দিয়ে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজ করতে বলেন। প্রাপ্ত টাকা দুজন ভাগ করে নেওয়ার ভিত্তিতে সম্মত হন আহসান। তিনি তখন তার বাল্যবন্ধু আজিজুলকে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কোনো সমস্যা থাকলে তা সমাধানের জন্য তার কাছে পাঠাতে বলেন।

চট্টগ্রামের তিনটি পাসপোর্টের নাম ও বয়স সংশোধনের জন্য গত ১২ আগস্ট আজিজুল ঢাকায় আহসানের কাছে আসেন। আলাউদ্দিন বিষয়টি জানতে পেরে আহসান ও আজিজুলকে মহানগর আবাসিক এলাকায় তার বাসায় নিয়ে যান। দুই সপ্তাহের মধ্যে সংশোধন করে দেওয়ার জন্য আলাউদ্দিনকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং আহসানকে এক লাখ টাকা দেন আজিজুল।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজ আল ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের একজন উচ্চমান সহকারী পদমর্যাদার ব্যক্তিকে আর্থিক সুবিধা দিয়ে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজ করাতেন আলাউদ্দিন। আজিজুলের দেওয়া তিনটি পাসপোর্ট সেই ব্যক্তিকে দিলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা করে দিতে পারেননি তিনি। আজিজুল পাসপোর্ট তিনটি সংশোধনের জন্য চাপ দিলে এক সপ্তাহ সময় চেয়ে নেন আহসান ও আলাউদ্দিন। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যেও তারা কাজটি করতে পারেননি। আজিজুল তখন আহসান ও আলাউদ্দিনের কর্মস্থলে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে নালিশ দেওয়ার হুমকি দেন। চাকরি হারানোর ভয়ে তখন তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আলাউদ্দিন ও আহসান।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আহসান বলেছেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১০ অক্টোবর তারা আজিজুলকে ঢাকায় আসতে বলেন। ওই দিন রাত ১১ টার দিকে আজিজুল ঢাকায় পৌঁছালে আহসান তাকে খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় তার বাসায় নিয়ে যান। খাবারের সঙ্গে তাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ান আহসান। রাত দেড়টার দিকে ঘুমন্ত আজিজুলকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন তিনি। এরপর তার হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে বেডশিট, মশারি ও পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে ফেলেন। মুঠোফোনে বিষয়টি তিনি আলাউদ্দিনকে জানান। নিজেকে সন্দেহের বাইরে রাখতে আলাউদ্দিন ওই সময় সিলেটে অবস্থান করছিলেন। সব কাজ করাচ্ছিলেন আহসানকে দিয়ে।

পুলিশ জানায়, আজিজুলকে হত্যার পর আহসানের পাশের রুমে থাকা তার রেস্টুরেন্টের সহকর্মী তামিম আকস্মিকভাবে সেখানে চলে আসেন। আহসান তাকে বিষয়টি কাউকে না বলার জন্য অনুরোধ করলে তামিম রাজি হন এবং আজিজুলের লাশ সুবিধাজনক স্থানে ফেলে দিতে আহসানকে সাহায্য করতে সম্মত হন। ১১ অক্টোবর লাশ বিছানার নিচে রেখে আহসান ও তামিম রেস্টুরেন্টে কাজ করতে চলে যান। সেখান থেকে একসঙ্গে ফিরে দিবাগত রাত দেড়টার দিকে আলাউদ্দিনের নির্দেশে তার নোয়া গাড়িতে করে লাশটি ফেলে দেওয়ার জন্য রওনা হন। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন আবদুর রহিম। আজিজুলের লাশ তারা হাতিরঝিলে ফেলে যান।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার হারুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে যাতে লাশের পরিচয় শনাক্ত করা না যায় সে জন্য আজিজুলের হাতের আঙুল বিকৃত করার পাশাপাশি মুখমণ্ডলও বিকৃত করা হয়। লাশের অদূরে ভেসে থাকা কাগজের টুকরোয় লেখা মুঠোফোন নম্বরের সূত্র ধরেই হত্যাকারীদের শনাক্ত করা হয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © banglarprotidin.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themebazarbanglaro4451