সোমবার, ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০১:১৬ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

বঙ্গবন্ধুকে ডিফেন্ড করে স্যার টমাসকে পাঠিয়েছিলেন ব্যারিস্টার সালেহউদ্দীন

বাংলার প্রতিদিন ডেস্ক ::
  • আপডেট সময় শনিবার, ১০ মার্চ, ২০১৮
  • ৫৯২ বার পড়া হয়েছে
বঙ্গবন্ধুকে ডিফেন্ড করে স্যার টমাসকে পাঠিয়েছিলেন ব্যারিস্টার সালেহউদ্দীন

অনলাইন ডেস্কঃ-

তিন দশক আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন লন্ডনের ইনার টেম্পল বারের সেই বাঙালি ব্যারিস্টার সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দীন। যিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণেতাদের একজন এবং সত্তরে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৪ আসামিকে রক্ষায় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্রিটিশ আইনপ্রণেতা ও আইনবিদ স্যার টমাস উইলিয়ামসকে লন্ডন থেকে ঢাকায় পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকী ওই মামলাকে কেন্দ্র করে ১৯৬৮ সালের ৭ জুলাই লন্ডনের পাকিস্তান দূতাবাসটি দখল করে নিয়েছিল যে ‘পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফেডারেশন’, তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই ব্যারিস্টার সালেহউদ্দীন। তাতে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় তারই উদ্যোগে গঠিত ‘দ্য রাইট অব ইস্ট পাকিস্তান ডিফেন্স ফ্রন্ট’ বঙ্গবন্ধুর মুক্তিসহ যে ঐতিহাসিক ৯টি দাবি তুলে ধরে, ব্রিটিশ গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য ইংরেজিতে টাইপকৃত তার মূল ‘প্রেস অ্যান্ড ইনফরমেশন হ্যান্ডআউট’টি আজও বিদ্যমান। এগুলো কীর্তিমান প্রয়াত ব্যারিস্টার সালেহউদ্দীনের ঢাকায় বসবাসরত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেটপুত্র সৈয়দ জাভেদ মোহাম্মদ সালেহউদ্দীনের সংরক্ষণে রয়েছে।

পুত্র ড. সৈয়দ জাভেদ মোহাম্মদ সালেহউদ্দীন দৈনিক আমাদের অর্থনীতিতে এই প্রতিনিধির আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসংক্রান্ত সাম্প্রতিক নিবন্ধগুলো পড়ে দলিল-দস্তাবেজ সরাসরি ইমেইলে পাঠিয়ে যোগাযোগ করেন। পরে টেলিফোনে প্রদত্ত ভাষ্যে জানান, যদিও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের কারণে ওই মামলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিলই নিজের সংরক্ষণে নেই; তবু পিতার অমূল্য কীর্তির কিছু আলোকচ্ছটা তার সংরক্ষণে রয়েছে, তারই কিছুটা পাঠিয়েছেন, আরও কিছু পাঠাবেন। তবে ১৯৮৩ সালের ২৪ মে মাত্র ৪৬ বছরে পিতার অকাল প্রয়াণকে কীভাবে দেখছেন জানতে চাওয়া হলে জানান, বাবা নেই তবু আজ বাবার কীর্তির কিছুটা জানাতে চাই জাতিকে, কেননা তা আমাদের ইতিহাসেরই অংশ।
আর এই অধ্যায়ে উন্মোচিত হয়েছে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি কেবল এই শোকাহত পুত্রের একান্ত স্মৃতিচারণই নয়, বরং তা যথাযথভাবে স্থান পেয়েছে ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে লন্ডনের অক্সফোর্ড ইউনিভাসির্টি প্রেস থেকে প্রকাশিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের তথ্যসচিব আলতাফ গওহর রচিত ৪৩৬ পৃষ্ঠার ‘আইয়ুব খান : পাকিস্তানস ফার্স্ট মিলিটারি রুলার’ গ্রন্থে। একইভাবে বিশদ বর্ণিত হয়েছে ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লুলু পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত ফারুক আহমেদ রচিত ২৮৮ পৃষ্ঠার ‘বেঙ্গল পলিটিক্স ইন ব্রিটেন’ গ্রন্থে। শেষটিতে ১৮৩১ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত- সময়ে বাঙালি রাজনীতির নানাবিধ উত্থান-পতনের বিষয়াবলি স্থান পেয়েছে। তবে আলতাফ গওহরের গ্রন্থে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান উদ্যোগী হয়ে নিজে বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মামলা থেকে রেহাই দিয়েছেন, পক্ষান্তরে সম্মিলিত বাহিনী তথা ‘জিএইচকিউ’ প্রধান ইয়াহিয়া খান তাকে ‘ফুলপ্র“ফ’ বা উজবুক প্রমাণে জড়িয়েছেন। এই গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে- ‘এজ এ রেজাল্ট অব আইয়ুবস ইন্টারভেনশন, শেখ মুজিবুর রহমানস নেম ওয়াজ ডিলিটেড ফ্রম দ্য লিস্ট অব একুউজড্’। তার আগে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিবৃত হয়েছে- ‘ইয়াহিয়া আসকড্ দ্য ইনফরমেশন সেক্রেটারি নট টু ওরি : উই হ্যাভ এ ফুলপ্র“ফ কেস’। একইসঙ্গে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের লন্ডন হোটেলে অবস্থানকালীন আগরতলা মামলা নিয়ে ছাত্রদের বিক্ষোভ প্রসঙ্গে রয়েছে- ‘দে হ্যাড সেট আপ এ রাইটস অব ইস্ট পাকিস্তান ডিফেন্স ফ্রন্ট অ্যান্ড এ্যাংগেজড্ টম উইলিয়ামস কিউ.সি. টু গো টু ঢাকা টু জয়েন দ্য টিম অব লইয়ার্স ডিফেন্ডিং শেখ মুজিব, দ্য ব্রিটিশ প্রেস, টু, ওয়াজ আনহ্যাপি অ্যাবাউট দ্য সারকামাসটেন্সেস অব দ্য কেস’। এই গ্রন্থে আরও উল্লেখ রয়েছে- বাংলাদেশ যে একদিন পাকিস্তান থেকে পৃথক হবে এবং আগারগাঁর ‘সেকেন্ড ক্যাপিটাল’টি যে বাংলাদেশেরই হবে- সে কথা স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তার প্রেস সচিবকে বলেছিলেন।

ফলে বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মামলা থেকে রক্ষায় ব্যারিস্টার সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দীন কেবল ওই ঐতিহাসিক ভূমিকাটিই রাখেননি, বরং তার রাজনৈতিক প্রতিভাগুলো ১৪ বছরের কিশোর অবস্থায় গ্রেফতার হয়ে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। মহান ভাষা আন্দোলনের সৈনিক হিসেবে ব্রিটেনে ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের সদস্য হওয়া এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ, বাংলাদেশ গণপরিষদ ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া তার উল্লেখযোগ্য ঘটনাই বটে। এছাড়া ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টি। একইসঙ্গে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বোয়ালমারী ডাকবাংলো ও ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলক থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প তত্ত্বাবধায়ক, জার্মান টেলিভিশনে হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার কাহিনী তুলে ধরা তার রাজনৈতিক বর্ণাঢ্যতারই প্রতিফলন। একইভাবে ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ফরিদপুরের বোয়ালমারী-আলফাডাঙা-বালিয়াকান্দি আসন থেকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে জনপ্রিয়তায় অপ্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বাক্ষরটিও রাখেন। পরে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ন্যাপে যোগ দিয়ে সংসদে ন্যাপের প্রতিনিধিত্ব করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ, নির্লোভ, নির্ভিক, প্রচারবিমুখ, সাদামাটা এবং সহজ-সরল জীবনের অধিকারী। মৃত্যুর পর তাকে বনানী কবর স্থানে দাফন করা হয়।

বলাবাহুল্য, ১৯৬৮ সালে লন্ডনে ‘দ্য রাইট অব ইস্ট পাকিস্তান ডিফেন্স ফ্রন্ট’ যে ঐতিহাসিক ৯টি দাবিসম্বলিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠায়। তাতে যেমন রয়েছে লন্ডন টাইমসের উদ্ধৃতি দিয়ে আগরতলা মামলায় কামালউদ্দীন আহমেদকে পাশবিক নির্যাতনের কথা, তেমনি রয়েছে ওই মামলায় জোর করে আদায়কৃত সাক্ষীর বক্তব্যকে কোর্টে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ৫ হাজার আইনজীবীর প্রতিবাদের কথা। এছাড়াও পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা। এতে দৃশ্যমান যে, জাতীয় অর্থনৈতিক অবদানের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের মোট জনগোষ্ঠীর ৫৭ শতাংশ অর্থাৎ ৬ কোটি মানুষের ৬৫ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তান থেকে আহরিত হলেও সেই সম্পদের ভাগীদার হয়েছে মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৮ সালের মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান ৩ হাজার ৮২২ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক অনুদান পেলেও পূর্ব পাকিস্তান পেয়েছে তার ২১ শতাংশ। জাতীয় প্রতিরক্ষা খাতে মূল বাজেটের ৬০ শতাংশই ব্যবহৃত হয়েছে।

তবে প্রয়াত ব্যারিস্টার সালেহউদ্দীনের স্বাধীনতা পরবর্তী সবিশেষ কৃতিত্বটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সদিচ্ছায় ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ইসলামী জোটভুক্ত ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের ক্ষেত্রে পল্টনের এক সভায় মাওলানা ভাসানীর সমর্থন জুগিয়েছিলেন। পূর্বাহ্নে সেক্ষেত্রে সাবেক পূর্তমন্ত্রী সোহরাব হোসেন সমন্বয়ক থাকলেও সন্তোষে ব্যারিস্টার সালেহউদ্দীনের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক ফজলে লোহানী ও বর্তমান ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নিলু। সে কথা শেখ শওকত হোসেন নিলু রচিত দ্বিভাষিক গ্রন্থ ‘পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ : ৪৩ বছরের রাজনীতি’ গ্রন্থে রয়েছে এবং তা গ্রন্থকার নিজে পুনরায় ফোনালাপে এই প্রতিনিধিকে নিশ্চিত করেছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © banglarprotidin.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themebazarbanglaro4451