জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া,সুনামগঞ্জ:
সুনামগঞ্জ জেলায় পাহাড়ী ঢলে ও বৃষ্টির পাতি একের পর এক হাওর ডুবায়
কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পরেছে। কষ্টের ফলানো সোনার ফসল পানিতে ডুবে
যাওয়ায় ঝড়ছে কৃষকের চোখের পানি। জেলার ১১টি উপজেলায় গত এক
সাপ্তাহে এ পর্যন্ত তাহিরপুর,ধর্শপাশা,জামালগঞ্জ,দিরাই,শাল্লা,ছাতক সহ
বিভিন্ন হাওরের ১০টি হাওরের কাচাঁ,আধা পাকা বোরো ফসল পানিতে
তলিয়ে গেছে। হাওর ডুবে লক্ষ লক্ষ কৃষকের একমাত্র বোরো ফসল রক্ষাবাঁেধ এ
পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাউকে দেখা যায় নি। গাঁ ডাকা
দিয়েছে পানি উন্নয়ন র্বোডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারী,ঠিকাদার
ও পিআইসির প্রতিনিধিরা।
এই দূর্যোগে মন্ত্রী,এমপি ও রাজনৈতিক নেতাদের কারো পদ চিহ্ন পরেনি
হাওরের বাঁধ গুলোতে। যার ফলে গত এক সপ্তাহ ধরেই জেলার প্রতিটি হাওরের
বাঁধ রক্ষায় কাজ করেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা,উপজেলা পরিষদ
চেয়ারম্যান ও জেলা প্রশাসক সহ হাওর পাড়ের অসহায় কৃষকগন দিন-রাত।
জেলার ডুবে যাওয়া হাওর গুলো হলো-তাহিরপুরের মহালীয়া হাওর,ধরনারদার
হাওর,টাংগুয়ার হাওর,এছাড়াও শনি ও মাটিয়ান হাওরের নিন্মাংশ
ডুবেছে,জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওর,দিরাইয়ের বারাম হাওর,চাপাতির
হাওর,টাংনির হাওর,শাল্লার ভেড়ামোহনা,ধর্মপাশার চন্দ্র
সোনারতাল,জামালগঞ্জের হালির হাওর,পাগনা হাওর পানিতে তলিয়ে গেছে।
এছাড়াও ভাংঙ্গন আতংকে আছে বিশ্বম্ভরপুরের খরচার হাওর,জেলা সদরের দেখার
হাওর সহ জেলার অন্যান্য হাওরগুলো।
জানা যায়,এ জেলার ১১টি উপজেলার ৪৬টি হাওরে আবাদী জমির পরিমান
৩,৭৯,২১৬ হেক্টর। এবার আবাদ করা জমির পরিমান-২,৭৬,৪৪৭ হেক্টর। তার মধ্যে
প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজারের অধিক হেক্টর জমিতে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও
বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। আর বাকি জমিতে অন্যান্য ফসল। জেলার ৪৬টি
হাওরের বাঁধ রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড এডিপি প্রকল্পের অধীনে ২২৫টি
পিআইসি এবং ৪৮টি প্যাকেজ প্রগ্রামের আওতায় ঠিকাদার নিয়োগের
মাধ্যমে দু-শত ৩০কিলোমিটার বাঁধ নিমার্ন ও মাটি ভরাটের কাজ নেয়।
পিআইসিতে ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা ও দরপত্রের মাধ্যমে কাজ আদায়ের জন্য
৪০ কোটি টাকার কাজ বরাদ্ধ পায় পাউবো। উৎপাদিত ধানের মধ্যে রয়েছে-
হাইব্রীড,স্থানীয় ও বাকি জমিতে উফশি আমন জাতীয় ধান চাষ করা
হয়েছে। এসব জমিতে প্রতি বছর ৯ লক্ষ মেঃটনের অধিক ফসল উৎপন্ন হয়। যার
মূল্য ১৫শ কোটি টাকার বেশী। জেলার ২৫ লক্ষাধিক জনসাধারনের মধ্যে প্রায়
২০ লক্ষাধিক মানুষ ঐ সব হাওরে চাষাবাদের উপর নির্ভর করে তাদের জীবন-
জীবিকা পরিচালিত করে থাকে। কিন্তু এ বছর পানি উন্নয়ন র্বোডের
মাধ্যমে তৈরী হাওর রক্ষা বাঁধ গুলো সঠিকভাবে সঠিক সময়ে নির্মান না
হওয়ায় বেশির ভাগ বালির বাঁধ ভেঙ্গে হাজার হাজার কৃষকের কষ্ঠার্জিত
সোনার ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এই ফসল ফলাতে কৃষকরা
এনজিও,ব্যাংক ও মহাজনের কাছ থেকে ছড়া সুদে নেওয়া ঋন পরিশোধ
কিভাবে করবে তা নিয়ে হতাশায় দিন পার করছে হাওর পাড়ের কৃষকরা।
অভিযোগ রয়েছে-গত ২৮শে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে এই জেলার ৪৬টি হাওরের বেরী
বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ করার সরকারি নির্দেশ থাকলেও ৪০ভাগ কাজও শেষ
করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার ও
পিআইসিগন নিজেদের খেয়াল খুশিমতো বাঁধের উপর থাকা গাছ-পালা
কেটে পরিস্কার না করে,বাঁধের দুই পাশ থেকে মাটি উত্তোলন করে কোন রকম
দায়সারা ভাবে বাঁধ নির্মান করে। নিদির্ষ্ট দূরত্ব থেকে মাটি এনে,বস্তায়
মাটি ভরে,বাঁশ দিয়ে প্রতিরক্ষা বাঁধ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও এখানে তা কেউ
শুনেনি। অনেক হাওর পাড়ে বাঁধ নির্মান না করে পানি বাড়ার সাথে সাথে
তড়িগড়ি করে নামমাত্র মাটি দেয় কর্মকর্তা কর্মচারী,ঠিকাদার ও
পিআইসির প্রতিনিধিরা। এসব অনিয়মের কারনে গত কয়েক দিনের বৃষ্টির
পানিতে জেলার বিভিন্ন উপজেলার ১৫টি বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়-জেলার ৪৬টি ছোট বড়
হাওরের বেশির ভাগই এক ফসলী জমি। এবার জেলার ১১টি উপজেলার ২ লাখ ২১
হাজার হেক্টর জমিতে ১৫ লাখ কৃষক বোরো ধানের আবাদ করেছে। উৎপাদনের
লক্ষ্যমাত্রা ৮লাখ মেট্রিকটনের অধিক। যার মুল্য দুই হাজার আট শত কোটি
টাকার বেশি। জেলার তাহিরপুর,
জগন্নাথপুর,দিরাই,শাল্লা,বিশ্বম্ভরপুর,ধর্মপাশা,মধ্যনগর সহ প্রতিটি
উপজেলার হাওরের শত শত হেক্টর কাঁচা,আধা পাকা বোরো জমির ধান বাধঁ
ভেঙ্গে পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিতে তলিয়ে যাওয়া হাওরের কাচাঁ,আধা
পাকা ধান এখন কাটছে কৃষকগন। এ পর্যন্ত প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমির
বোরো ধান পানিতে ডুবে গেছে। খেলু মিয়া,আতিক,সাদেক
আলী,উত্তম পুরকায়স্থ,অপু তালুকদার সহ জেলার বিভিন্ন হাওর পাড়ের
কৃষকগন জানান,পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৈরি বালির বাঁধ বাঁধ ভেঙ্গে
পানি হাওরে প্রবেশ করে কোটি কোটি টাকার কষ্টের সোনার ফসল পানিতে
তলিয়ে গেছে। এই ফসল ফলাতে আমরা বিভিন্ন এনজিও,ব্যাংক ও মহাজনের
কাছ থেকে ঋন নিয়েছি। কিভাবে ঋন পরিশোধ করব ভেবে পাচ্ছি না।
তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুস ছালাম জানান-হাওরের
বাঁধ গুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় ছিল এবং এখনও আছে। উপজেলার
মহালীয়া,ধরুনদার হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। এছাড়া ছোট ছোট
কয়েকটি হাওরের ধান পানিতে ডুবে গেছে। আমি হাওর পরিদর্শন ও
কৃষকদের সাথে কথা বলেছি। এ বছর উপজেলায় ১৮ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে
ধান চাষ করা হয়েছে। বাধঁ ভেঙ্গে ১০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ফসল
পানিতে তলিয়ে গেছে।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন-
সঠিক ভাবে বাঁধ নির্মাণ না করার কারণে হাওরের প্রতিটি বাঁধ খুবই
দূবর্ল ছিল অনিয়মের কারনে বাঁধ গুলো ভাঙ্গতে শুরু করেছে। বাঁধ রক্ষায় আমি
সর্বক্ষনই হাওরে অবস্থান করে নিজেই কৃষকদের সাথে নিয়ে বাঁধে মাটি
বরাটের কাজ করে শেষ রক্ষার চেষ্টায় আছি। তবে বাঁধ নির্মানে
অনিয়মকারীদের কোন ভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন-আমি নিজে
বিভিন্ন হাওরের বাঁধ রক্ষার জন্য এলাকাবাসী কে নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে
যাচ্ছি। যারা বাঁধ নির্মানে অনিয়ম করছেন তাদের বিরোদ্ধে শাস্তি মুলক
ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ পরিচালক জাহেদুল হক
জানান,বাঁধ ভেঙ্গে জলাবব্ধতার কারনে জেলার প্রায় ১০হাজার হেক্টর ফলানো
বোরো জমি তলিয়েছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় ঝুঁিকর পরিমান বাড়ছে।
সুনামগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী
আফছার উদ্দিন জানান,আমাদের রক্ষানাবেক্ষনকৃত ৩৭টি হাওরের মধ্যে ৭টি
হাওওে পানি প্রবেশ করেছে। তাতে প্রায় ১০হাজার হেক্টরের অধিক জমির
ফসলের ক্ষতি হয়েছে। পানি হাওরের বিপদসীমা অতিক্রম করছে।