একে.এম নাজিম, হাটাহাজারীঃ হেফাজতে ইসলামের আমীর শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ
শফী বলেছেন, বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে
দিয়ে ফায়দা লুটার জন্যে দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্থবিরোধীরা গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। বি-
বাড়িয়ার নাসিরনগরসহ দেশের আরো কয়েকটি স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও ধর্মীয়
উপাসনালয়ে হামলার ঘটনাকে অস্বাভাবিক ও ষড়যন্ত্রমূলক উল্লেখ করে বলেন, কোন সাধারণ
নাগরিক এসব ঘটনার সাথে জড়িত নয় বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এসব ঘটনার পেছনে
দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের কালো হাত রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিবেশী ভারত,
মায়ানমারসহ পশ্চিমা বিশ্বের বহু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের নেতাদের বক্তব্যে ও মিডিয়ায়
সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমাণত্মক ও ঘৃণাবাঞ্জক বক্তব্য ও হামলায় প্রকাশ্য উস্কানী
দিয়ে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। অথচ আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় ও
সামাজিক সংগঠনের উঁচু পর্যায় থেকে শুরু করে কোন স্তরের নেতৃবৃন্দসহ ব্যক্তিগত
পর্যায়েও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক বক্তব্য দিতে কখনো দেয় না। সংখ্যালঘুদের
সার্বিক স্বার্থরক্ষায় বাংলাদেশে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে অভূতপূর্ব ঐক্য বজায় রয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যারিষ্ঠ দেশ হলেও এখানে শত শত বছর ধরে হিন্দু, বৌদ্ধ,
খ্রীস্টান ও উপজাতীয় জনগোষ্ঠীসহ সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করছেন। এই
সম্প্রীতিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও সতর্ক ও সজাগ
থাকতে হবে। কারণ, বাংলাদেশের শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও উন্নতির জন্যে সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতি সুন্দর রাখা অত্যন্ত জরুরী।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেন, ইসলাম অর্থ হচ্ছে শান্তি। তাই ইসলাম সবসময় শান্তির শিক্ষা
দিয়ে থাকে। অমুসলিমদের প্রতি সহানুভূতি ও সদাচারণের বিষয়ে ইসলামে স্পষ্ট নির্দেশনা
রয়েছে। রাসূল (সা.)এর যাতায়াতের পথে যেই বৃদ্ধ ইহুদী নারী নিয়মিত কাঁটা পুঁতে দিত, তার
অসুস্থতার খবর শুনে প্রিয়নবী তাকে দেখতে তার বাড়ি গিয়েছিলেন। অমুসলিমদের প্রতি
সদাচরণের অগণিত নজির ইসলামের ইতিহাসে রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের আলেমদের
অমুসলিমদের প্রতি সুন্দর সম্প্রীতিপূর্ণ মনোভাবের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, দারুল উলূম
হাটহাজারী মাদ্ধসঢ়;রাসা বাংলাদেশের প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র। এই মাদ্ধসঢ়;রাসার
প্রধান জামে মসজিদের মাত্র ৫ গজের মধ্যেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সীতাকালী মন্দির অবস্থিত।
অথচ এ যাবত কখনোই মাদ্ধসঢ়;রাসার হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষকদের সাথে মন্দিরের সামান্যতমও
গোলযোগের নজির নেই।
শাহ আহমদ শফী বলেন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীসহ বৌদ্ধ ভিক্ষু ও
সন্ত্রাসীরা যেই নৃশংস হত্যাকান্ড, নির্বিচার ধর্ষণ, বাড়ী-ঘরে আগুন ও বর্বরোচিত
উচ্ছেদাভিযান চালাচ্ছে, পৃথিবীর ইতিহাসে জাতিগত এমন বর্বরতার নজির নেই। মিয়ানমারের
ঘটনায় বাংলাদেশের মুসলমানগণ অত্যন্ত মর্মাহত, ক্রুদ্ধ ও প্রতিবাদমূখর। বাংলাদেশের মুসলিম
জনতার পাশাপাশি এদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও মিয়ানমার সরকারের নির্মমতা ও অত্যাচারের
বিরুদ্ধে সাংবাদিক সম্মেলন, মানববন্ধনসহ প্রতিবাদে শামিল হয়েছে, এটা প্রশংসনীয়
উদ্যোগ। বাংলাদেশের সুন্দর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্যেও এটা উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত
হবে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের ঘটনায় বাংলাদেশে বসবাসকারী বৌদ্ধসম্প্রদায়ের লোকজনের
উপর এদেশের মুসলমানদের কোন নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে না, ইনশাআল্লাহ। হেফাজত
আমীর বর্মার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোন দুষ্কৃতিকারী মহল যেন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক
উস্কানীর মতো কোন ঘটনা ঘটাতে না পারে, সে জন্যে সকলের সজাগ ও সতর্ক থাকার প্রতি
গুরুত্বারোপ করেন।
গতকাল (৩ ডিসেম্বর) শনিবার বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের উচ্চপর্যায়ের এক প্রতিনিধি
দল হেফাজত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর সাথে তাঁর কার্যালয়ে দেখা করতে এলে তিনি
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে এসব কথা বলেন। সম্মিলিত বৌদ্ধ নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক
লোকপ্রিয় বড়–য়ার নেতৃত্বে বৌদ্ধ প্রতিনিধি দলে ছিলেন, সমন্বয়কারী মিথুন বড়–য়া,
বৌদ্ধ ভিক্ষু শ্রী মৎ লোকজিৎ খের, শ্রী মৎ সংখানন্দ খের, প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়–য়া,
অধ্যাপক ঝন্টু কুমার বড়–য়া, সীমান্ত বড়–য়া, শিক্ষক লিটন বড়–য়া, নিরুপম বড়–য়া, বৌদ্ধ
ভিক্ষু শ্রী মৎ শাসন বংশ মহাথের, বৌদ্ধ ভিক্ষু পূর্ণানন্দ থের, বৌদ্ধ ভিক্ষু দিপানন্দ থের, বৌদ্ধ
ভিক্ষু ইন্দ্রসেন, বৌদ্ধ ভিক্ষু জ্যোতিপাল শ্রমন প্রমুখ। সাংবাদিক প্রতিনিধিদের মধ্যে
উপস্থিত ছিলেন দৈনিক যুগান্তর হাটহাজারী প্রতিনিধি আবু তালেব এবং বাংলার চোখ-এর
হাটহাজারী প্রতিনিধি আজিজুল ইসলাম। সন্ধ্যা ৬টায় থেকে সাড়ে ৭টা পর্যন্ত দেড়
ঘণ্টাব্যাপী হেফাজত আমীরের সাথে বৌদ্ধ প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়। এসময় হেফাজত আমীরের
সাথে আলোচনায় শরীক ছিলেন, সংগঠনের যুগ্মমহাসচিব মাওলানা মুঈনুদ্দীন রুহী, প্রচার
সম্পাদক মাওলানা আনাস মাদানী, আমীরের প্রেসসচিব মাওলানা মুনির আহমদ, হাটহাজারী
মাদ্ধসঢ়;রাসার শিক্ষক মাওলানা নূরুল ইসলাম, মাওলানা আব্দুল্লাহ নজীব, হেফাজত নেতা মাওলানা
হাজী মুজাম্মেল হক, মাওলানা হাবীবুল্লাহ আজাদী প্রমুখ।
বৌদ্ধ প্রতিনিধি দলের পক্ষে সম্মিলিত বৌদ্ধ নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক লোকপ্রিয় বড়–য়া,
সমন্বয়কারী মিথুন বড়–য়া, বৌদ্ধ ভিক্ষু শ্রী মৎ লোকজিৎ খের, শ্রী মৎ সংখানন্দ খের,
প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়–য়া বক্তব্য রাখেন। তারা বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর যে
নৃশংস হত্যাকান্ড, অবাধ ধর্ষণ, বাড়ি-ঘরে অগ্নি দেওয়াসহ মুসলিম জাতিগত যে উচ্ছেদ
অভিযান চালানো হচ্ছে, আমরা এর তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানাই। এসব
মানবতাবিরোধী অপরাধ বুদ্ধ ধর্মের শান্তির শিক্ষার চরম অবমাননা। বর্মার ঘটনায়
বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হিসেবে আমরা লজ্জিত ও অপমানিত। তারা বলেন, রোহিঙ্গা মুসলিমদের পক্ষে
মিয়ানমারের শাসক মহলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি আন্দোলনে আমরাও শামিল হয়েছি। ন্যায় ও শান্তির
পক্ষে আমাদের প্রতিবাদ কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে। এ সময় প্রতিনিধি দলের নেতারা হেফাজত
আমীরের আন্তরিকতা ও সম্প্রীতির কথায় মুগ্ধ হয়ে ভূয়ষি প্রশংসা করে শাহ আহমদ শফীকে উদ্দেশ্য
করে বলেন, “আপনি বাংলাদেশের মুসলমানদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শীর্ষ নেতা। আমাদের প্রতি
আপনি যে আন্তরিকতা ও সহানুভূতি দেখিয়েছেন, তাতে আমরা মুগ্ধ ও আশ্বস্ত। সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতির উপর আপনার দৃষ্টিভঙ্গি অনেক মূল্যবান ও অভিভূত হওয়ার মতো। আমরা আপনার সাথে
দেখা করে এবং দীর্ঘ আলোচনা করে অনেক সুন্দর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, অনেক কিছু
শিখতে ও জানতে পেরেছি। ইসলামের সত্যিকারের সৌন্দর্য ও শান্তির বার্তা আমরা আজকে
আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করছি। রোহিঙ্গার নির্যাতিত, নিপীড়িত মুসলমানদের পক্ষে আমাদের
প্রতিবাদি কর্মসূচী অব্যাহ থাকবে। আমরা আপনার কাছে বিশেষভাবে আশা করছি,
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সুন্দর সহাবস্থান অটূট রাখার বিষয়ে আপনি
নেতৃত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। আমরা বিশ্বাস করি, আপনার যে কোন আহ্বান অনেক মূল্যবান
ও ফলদায়ক”।
হেফাজত আমীর বৌদ্ধ প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করে বলেন, আমরা বর্মার মানবতা বিরোধী
অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি, কোন সাম্প্রদায়িক আওয়াজ আমরা তুলিনি। ইসলাম
শান্তির শিক্ষা দেয়। সেই মতে বাংলাদেশের মুসলমানরা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। বাংলাদেশের
বৌদ্ধধর্মাবলম্বীসহ অন্যান্য সকল অমুসলিম নাগরিকদের সার্বিক নিরাপত্তা ও নাগরিক
অধিকারের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
হেফাজত আমীরের সাথে বৈঠকের পূর্বে বৌদ্ধ প্রতিনিধি দলটি দারুল উলূম হাটহাজারী
মাদ্ধসঢ়;রাসার মুখপত্র ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম’ কার্যাল পরিদর্শন করেন। এ সময় পত্রিকাটির
নির্বাহী সম্পাদক ও হেফাজত আমীরের প্রেসসচিব মাওলানা মুনির আহমদ প্রতিনিধি দলকে
অভ্যর্থনা জানান এবং রোহিঙ্গা ইস্যু ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিষয়ে প্রতিনিধি দলের
সাথে মতবিনিময় করেন। বৌদ্ধ প্রতিনিধি দলকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নে হেফাজতে
ইসলামের দৃঢ় অবস্থানের বিষয়ে আশ্বস্ত করে মাওলানা মুনির আহমদ জানান, রোহিঙ্গা ইস্যুতে
হেফাজতে ইসলামের যে কোন কর্মসূচী প্রণয়নে এদেশে বসবাসকারী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের
নিরাপত্তা বিঘিœত করতে কোন দুষ্কৃতিকারি যেন হেফাজতের কর্মসূচীকে ঢাল হিসেবে
ব্যবহার করতে না পারে, সেই দিকটাও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
সবশেষে বৌদ্ধ প্রতিনিধি দলকে জুস, কেক, আপেল দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়। রাত ৮টায়
প্রতিনিধি দলকে হেফাজত নেতৃবৃন্দ আন্তরিকভাবে বিদায় জানান।