সূর্যাস্তের পর অন্ধকার নেমে এলেই নাফ নদীতে দেখা যায় নৌকার সারি। মিয়ানমার সরকারের নিপীড়ন ও অত্যাচার থেকে প্রাণে বাঁচতে রোহিঙ্গা মুসলিমরা দলে দলে সীমান্ত পারি দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে এ দেশে প্রবেশ করাচ্ছে দালালরা। অনেকে বিজিবির হাতে ধরা পড়লেও মানবিক সহায়তা দিয়ে তাদেরকে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় না। পরদিন ঠিকই দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে তারা।
কয়েকজন রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দালালের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। এ জন্য দিতে হয়েছে নগদ টাকা। মংডুর নাইক্ষ্যংবিল গ্রামের রশিদা (২২) ও মোমেনা বেগম (৪৫) বাংলার প্রতিদিন অনলাইনকে জানান, সোমবার সকালে তাদের আটক করে বিজিবি জওয়ানরা। সন্ধ্যায় স্বদেশে ফেরত পাঠালেও দালালদের সহযোগিতায় রাতেই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন তারা। এ জন্য তাদের দিতে হয়েছে ১০ হাজার করে টাকা।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্বিচারে হত্যা-নির্যাতন চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক রোহিঙ্গা। শ’ শ’ বাড়িঘরে ভাঙচুর-হামলা এবং আগুন দেয়া হয়েছে। হামলা-নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে হাজারো রোহিঙ্গা। অনুপ্রবেশ ঠেকানোসহ যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সীমান্তে বাড়তি সতর্কতা নিয়েছে বিজিবি। টেকনাফ সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত সদস্যও।
এদিকে বৃহস্পতিবার ভোরে উখিয়া সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রায় শতাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের ফেরত পাঠানো হয়। এদের মধ্যে পুরুষ, নারী ও শিশুসহ প্রায় ১০৫ জন ছিল। টেকনাফের নাফ নদীতে রোহিঙ্গাবাহী ৮টি নৌকাও ফিরিয়ে দিয়েছে বিজিবি।
টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আবু জার আল জাহিদ জানান, নাফ নদীর ৬টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাবাহী ৮টি নৌকা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের বাংলাদেশে ঢুকতে না দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।
গেলো বুধবার সকালে লেদা বিওপির জওয়ানরা রঙ্গিখালী এইচকে আনোয়ার প্রজেক্টে প্রায় দেড় শতাধিক শিশু নারী ও পুরুষ রোহিঙ্গাকে আটক করে। তবে সেখানে তথ্য সংগ্রহের জন্য কোনো সাংবাদিককে ঢুকতে দেয়নি বিজিবি।
হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান এইচকে আনোয়ার জানান, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুকে আটক করেছে বিজিবি জওয়ানরা। তাদের চিংড়ি ঘেরের বাসায় রাখা হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে বিজিবি হেফাজতে রয়েছে। এসব রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাফ নদী হয়ে সীমান্তের হোয়াইক্যংয়ের খারাইংগা ঘোনা, মিনা বাজার, খারাংখালী, কাঞ্জর পাড়া, লম্বাবিল, হ্নীলার জাদিমুরা, নোয়াপাড়া, লেদা, মোচনী, নাইট্যং পাড়া, কায়ুকখালী খাল দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে।
বাংলাদেশে অবস্থানরত কয়েকজন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির রাখাইন প্রদেশে ব্যাপক খুন, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালাচ্ছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। পুরুষদের ধরে ধরে চোখ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। নির্মমতার মাত্রা এতো তীব্র পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বাধ্য হয়ে সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলমানরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন।
মংডুর খারীরবিলের মাজুমা (৩০) ও বলি বাজারের আবদুল মালেক (৫০) জানান, নির্যাতন থেকে প্রাণে বাঁচতে মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন তারা।
তাদের অভিযোগ, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে, পুরুষদের ধরে গুলি করছে, নয়তো গলা কেটে ফেলছে। এতে স্বামীহারা হচ্ছেন বহু নারী।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ভয়াবহতা স্যাটেলাইটে তোলা ছবিতেও ফুটে উঠছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে- রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে ১২শ’র বেশি ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।
যদিও এ অভিযান চালানোর কারণ হিসেবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী উল্লেখ করে, রাখাইন প্রদেশে সম্প্রতি শুরু হওয়া বিদ্রোহ দমনের অংশ হিসেবে এ অভিযান। গেলো ৯ অক্টোবর রাখাইন সীমান্ত চৌকিতে হামলার জের ধরেই তারা এ অভিযান চালাচ্ছে।