বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৫৪ পূর্বাহ্ন

বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডি নিয়োগে বয়স নিয়ে বিভ্রান্তি কেন?

বাংলার প্রতিদিন ডেস্ক ::
  • আপডেট সময় রবিবার, ১২ জুন, ২০১৬
  • ৩৭৮ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিবেদক: বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে কত বয়স পর্যন্ত চাকরি করা যাবে, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায়ই স্পষ্ট করা আছে। নীতিমালায় সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ৬৫ বছর পর্যন্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা এমডি পদে নিয়োগ করা যাবে। তারপরও এমডি পদে নিয়োগের বয়স নিয়ে অহেতুক কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। ডেপুটি গভর্ণরদের নিয়োগকে এক্ষেত্রে অযৌক্তিকভাবে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনা হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ডেপুটি গভর্ণরদের নিয়োগের ধরন, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ও কর্মক্ষেত্র সম্পূর্ণ আলাদা। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পরিচালিত হয়। ব্যাংক কোম্পানি আইনে এমডি পদে নিয়োগের পুরো ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদের হাতে দেয়া হয়েছে। পরিচালনা পর্যদের এই নিয়োগ অনুমোদন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিকে নিয়ম অনুযায়ী ডেপুটি গভর্ণর পদে নিয়োগ দেয় সরাসরি সরকার।

বিশেষায়িত ব্যাংক ব্যতীত বাংলাদেশে কার্যরত সকল ব্যাংকের জন্য পালনীয় বাংলাদেশ ব্যাংকের জারিকৃত বিআরপিডি সার্কুলার নং-১৮তে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা এমডি-দের বয়স সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। সর্বশেষ, ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর জারিকৃত ওই সার্কুলারের ৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কোনো ব্যক্তির বয়স ৬৫ (পয়ষট্টি) বছর অতিক্রান্ত হলে তিনি কোনো ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না।”

সার্কুলারের ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “প্রধান নির্বাহীর নিয়োগের মেয়াদ হবে অন্যূন ৩ (তিন) বছর, তবে তিনি পুনঃনিয়োগযোগ্য হবেন। প্রার্থীর বয়স যদি ৬৫ বছর অতিক্রান্ত হতে ৩ (তিন) বছরের কম সময় থাকে তবে সেক্ষেত্রে উক্ত সময়ের জন্যও তাকে নিয়োগ করা যাবে।”

এদিকে ব্যাংক কোম্পানি আইনে (২০১৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত) পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে, “বিশেষায়িত ব্যাংক ব্যতীত অন্য যে কোনো কোম্পানিকে উহার পরিচালক, ব্যাবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিযুক্তি বা পদায়নের পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণ করিতে হইবে। এইরূপ নিযুক্ত কর্মকর্তাগণকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে তাহার পদ হইতে অব্যাহতি দেওয়া, বরখাস্ত করা বা অপসারণ করা যাইবে না।” অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা এমডি নিয়োগ দিবে, তবে তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন লাগবে।

তাই বিশ্লেষকদের মতে, এমডি বা প্রধান নির্বাহী নিয়োগের বিষয়ে ডেপুটি গভর্ণরকে তূলনায় আনা যায় না। এমন অযৌক্তিক বিষয়কে তূলনায় এনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হলে গোটা ব্যাংকিং খাতই বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়বে। কারণ, ইতিমধ্যে সবক’টি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুসরণ করেই ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত এমডি নিয়োগ দিয়ে আসছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ব্যাংকিং খাতে এমনিতেই এমডি বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পর্যায়ে অভিজ্ঞতার সংকট রয়েছে। অভিজ্ঞ ব্যাংকারের সংকটের কারণে এমডি পদে ৬৫ বছরের যে সময়সীমা বর্তমানে আছে তা বাড়ানোরও দাবি উঠেছে। সার্কভুক্ত দেশ পাকিস্তানে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত এমডি পদে নিয়োগের বিধান রয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোসহ অনেক দেশে বয়সের কোনো সীমারেখাই নির্ধারণ করা নেই। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ্য যে কোনো দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিকেই ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বা এমডি পদে নিয়োগ করা যায়। বাংলাদেশেও বয়স বাড়ানোর সময় এসেছে বলে মনে করছেন ব্যাংকিংখাতের বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশে বিচারপতিদের বয়স ইতিমধ্যেই ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করা হয়েছে।

সূত্রমতে, ৬৫ বছর বয়সের সীমারেখা থাকায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ অনেক এমডির চাকরির মেয়াদ শেষ হবে এ বছরের মধ্যে এবং আগামী বছরের শুরুতেই। এত সংখ্যক এমডি অবসরে গেলে ব্যাংকিংখাতে অভিজ্ঞ ও দক্ষ এমডির সংকট দেখা দিবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি এক ব্যাংকের এমডির মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের পরিধি বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে অনেক কার্যক্রম। এখন একটি ব্যাংক শুধু গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় ও বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করে না। ব্যবসার সক্ষমতা দেখা, নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দেওয়া, নারী উদ্যোক্তাদের সামনে আনাসহ অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য সরকারের নেওয়া বিভিন্ন প্রণোদনা নিয়ে কাজ করতে হয়।

এছাড়াও দেশের প্রচলিত আইনের জন্য সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়ীক সংগঠনের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ বজায় রাখতে হয়। যা শুধু একজন অভিজ্ঞ এমডিই পারেন বলে জানান এই ব্যাংকার।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ শীর্ষ নিউজকে বলেছেন, ব্যাংকিং খাতে দক্ষ লোকের অভাব আছে একথা সত্য। সরকারের অন্যান্য অফিসের দিকে খেয়াল রেখে এমডি নিয়োগের বয়স বাড়ানো যেতে পারে।

তিনি বলেন, আমেরিকা, ইংল্যান্ডের মতো উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই শীর্ষ নির্বাহীদের দায়িত্ব পালনের জন্য বয়সগত কোনো বাধা নেই। সেক্ষেত্রে শুধু দেখা হয় তারা কর্মক্ষম কি-না। মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা, শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে সক্ষম হলেই, তারা দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, দায়িত্ব পালনে বয়স পরিমাপের ক্ষেত্রে যে কোনো মানুষের তিনটি বিষয় বিবেচনা করা হয়। তার মধ্যে শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা থাকলে এমডিদের দায়িত্ব পালনে বয়স কোনো সমস্যা হতে পারে বলে আমি মনে করি না। যেহেতু এমডিদের বেলায় দায়িত্ব পালনে ৬৫ বছর বয়স নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিধান আছে, সেজন্য সরকারের অন্যান্য সার্ভিস বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করা যেতে পারে। এমডিদের বয়স ২-১ বছর আরো বাড়ানো যেতে পারে। তবে, ব্যাংকের এমডি নিয়োগে ব্যক্তিদের নৈতিকতা ও পেশাগত দক্ষতাকেই বিবেচনা করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এখন আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে। এমডি পদে অভিজ্ঞতা অজর্নকারীদের আত্ম-বিশ্বাস অনেক বেশি থাকে। নতুন প্রজন্মও দক্ষ হচ্ছে। কিন্তু দক্ষতার সঙ্গে যদি অভিজ্ঞতার সংযোগ হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানের উন্নতি হয়। ব্যাংকের আর্থিক দিক স্থিতিশীল হয়। সেজন্য অভিজ্ঞদের কাছ থেকে আরো কিছু দিন সেবা নিতে পারলে দেশের ব্যাংকিংখাত সমৃদ্ধ হবে। তাই বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডিদের বয়স ৬৫ বছর থেকে কিছুটা বাড়ানো যেতে পারে বলেই অভিমত দেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ নীতি অনুযায়ী বিশেষায়িত ছাড়া কোন বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডি নিয়োগে ব্যক্তির ব্যাংকিং খাতে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এছাড়াও এমডির আগের পদে দায়িত্ব পালন করার কমপক্ষে দুই বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তার বিরুদ্ধে কোন প্রকার অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ বা আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হলে তাকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। সর্বোচ্চ ৬৫ বছর পর্যন্ত তিনি ব্যাংকের এমডি পদে থাকতে পারবেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © banglarprotidin.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themebazarbanglaro4451