আজ ভয়াল ২০ মে। প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের দীর্ঘ এক বছর পার হলেও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার কয়েক লাখ মানুষ। বিধবা অঞ্জনাবালা দাস (৬১)। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে শ্যামনগরের পদ্মপুকুর এলাকার ঝুপড়ি ঘরে গত এক বছর ধরে বসবাস করে আসছেন। বিঘা দেড়েক একফসলী কৃষি জমি আছে তার। আম্ফানের রাতে ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে উড়ে যায় বাড়িঘর। ধেয়ে আসা পানির সাথে বালু এসে ডুবে যায় তার উর্বর ফসলী জমি। সরকারি-বেসরকারি সহায়তা মিললেও ফিরে আসেনি বালুতে ভরাট হয়ে যাওয়া উর্বর জমিটি।
আলাপকালে তিনি জানান, আম্ফানের পর এলাকায় বেড়েছে নোনা জলের তীব্রতা। লবণাক্ততায় কৃষিকাজ হয় না উপকূলে। তাই অভাবগ্রস্ত তার মতো অধিকাংশ মানুষ। বেড়িবাঁধ ভাঙনের আতঙ্কে এখনও তটস্থ সবাই। যোগাযোগব্যবস্থাও রয়েছে বিচ্ছিন্ন। চিকিৎসা, সুপেয় পানি, স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন সংকটে বিপর্যস্ত উপকূলীয় এলাকার লক্ষাধিক মানুষ।
গত বছরের এই দিনটিতে আম্ফানের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয় গোটা সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা। পানিবন্দি হয়ে পড়ে উপকূলীয় এলাকার ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ। ঘর-বাড়ি ধ্বসে পড়ে ২ হাজারেরও বেশি। এখনো ডুবে আছে শতাধিক ঘরবাড়ি। এতে মাছের ক্ষতি হয় ১৭৬ কোটি ৩ লাখ টাকার। কৃষিতে মোট ক্ষতি হয় ১৩৭ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার টাকার। এলজিইডি ও সড়ক বিভাগের ক্ষতি হয় কমপক্ষে ৩০ কিলোমিটার সড়ক। কাজ না থাকায় সেখানকার লোকজন বর্তমানে বেকার হয়ে পড়েছেন। সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনির ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, গৃহহীনের সংখ্যা এখনও দুই শতাধিক। বেড়িবাঁধের রাস্তার ওপর খুপড়ি ঘরে বসবাস করেন এই গৃহহীনরা। সুপার সাইক্লোন আম্ফানের ক্ষত আজও বয়ে নিয়ে চলেছে উপকূলের মানুষ।
জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, শ্রীউলা ও আশাশুনি ইউনিয়নের মানুষ এক বছর আশ্রয়ের জন্য ছুটছেন। খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদের লোনা পানির জোয়ার ভাটায় বাঁশের মাচায়, ওয়াপদা রাস্তায় সাইক্লোন শেল্টারে অথবা গ্রামছাড়া হয়ে বিভিন্ন আত্মীয়ের বাড়িতে বা শহরের দিকে নিরুদ্দেশ যাত্রায় দিন কাটিয়েছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রতাপনগর ও শ্রীউলার ৭টি পয়েন্টের বাঁধ মেরামত করে লোকালয়ে লোনা পানির জোয়ার আটকানো হয়েছে প্রায় ৯ মাস পর। বাঁধ হওয়ার পরেও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় এখনো মানুষ ফিরতে পারেনি।
আশাশুনি উপজেলার শুভদ্রকাটি গ্রামের আতাউর রহমান ও কুড়িকাউনিয়া গ্রামের আবু সালেহসহ উপকূলীয় এলাকাবাসীরা জানান, তাদের এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। নেই চিকিৎসার ব্যবস্থা। সুপেয় পানির সংকট তীব্র। বেড়িবাঁধের অবস্থাও নাজুক। উপকূলীয় এলাকার এ সব মানুষ সরকারের কাছে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও টেকসই বেড়িবাধ নির্মাণের দাবি জানান।
আশাশুনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অসিম কুমার চক্রবর্তী জানান, ঝড়ে কোনো মানুষের প্রাণহানী বা আহত হওয়ার ঘটনা না ঘটলেও ২ শতাধিক গবাদি পশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝড় বা বন্যায় ১৫ হাজার ৮০০ নারী, ২৫ হাজার ২০০ পুরুষ, ৩১০০ শিশু ও ৮৩৫ জন প্রতিবন্ধীকে স্থানাচ্যুত হয়েছে। এই প্রলয়ংকারী ঝড় এক বছরেও উপকূলীয় মানুষদের এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয়নি। আজও সেখানকার মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের অভাব রয়েছে। একই সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও রয়েছে বিচ্ছিন্ন। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেঁড়িবাধগুলো রয়েছে ভয়াবহ অবস্থায়। দু’একটি জায়গায় সংস্কার করা হলেও অধিকাংশ জায়গায় রয়েছে ভয়াবহ ফাটল। যেকোনো সময় প্রবল জোয়ারের চাপে তা আবারও ভেঙে বিস্ীর্ণ এলাকা প্লাবিত হতে পারে। তিনি টেকসই বেঁড়িবাধ নির্মাণে এ সময় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস.এম মোস্তফা কামাল জানান, ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছিল এ অঞ্চলের বেড়িবাঁধগুলোর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে, অতিসত্ত্বর ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাধ সংস্কারের। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসন, পানিউন্নয়ন বোর্ড, সেনাবাহিনীসহ জেলার সংশ্লিষ্ট সংস্থা অক্লান্ত পরিশ্রম করায় বাঁধগুলো প্রাথমিকভাবে সংস্কার করা সম্ভব হয়েছে। তিনি এসময় সাতক্ষীরা জেলাকে দুর্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত জেলা ঘোষণার দাবি জানান।