শুভ ঘোষ,মুন্সীগঞ্জ থেকে ফিরে: মুন্সীগঞ্জ শহর ও
আশপাশ এলাকায় গড়ে ওঠা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক
অ্যান্ড প্যাথলজিক্যাল সেন্টারগুলোতে চলছে চিকিৎসার
নামে কমিশন বাণিজ্যের ব্যবসা। এ জন্য মুন্সীগঞ্জ
জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার, নার্স ও
দালালদেরই দায়ী করছে সচেতন মহল। তারা মনে করছেন,
তাদের কমিশন বাণিজ্যের কারণে দিন দিন এসব
ব্যবসা জমজমাট হচ্ছে। সরকারি স্বাস্থ্যনীতির
তোয়াক্কা না করে এসব প্রতিষ্ঠান গুলোতে
চিকিৎসার নামে চলছে রোগীদের জীবন বিপন্ন
করার কাজ ।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি হাসপাতালে ও ডাক্তার
চেম্বারে চিকিৎসা নিতে গেলে দূরদূরান্ত থেকে
আসা রোগীদের প্রয়োজন ছাড়াই রক্ত, প্রসাব পরীক্ষা,
আলট্রাসনোগ্রাম, এক্স-রেসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-
নিরীক্ষার ব্যবস্থা পত্র ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বলে
দেওয়া হচ্ছে, কোন প্রতিষ্ঠানে এ পরীক্ষাগুলো করতে
হবে। তাই রোগীরা ডাক্তারের নির্দেশিত
প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরীক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন,শারীরিক
সুস্থতা কামনার আসায়। এ সুযোগে
ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড প্যাথলজিক্যাল সেন্টারগুলোর
মালিকপক্ষ রোগীদের কাছ থেকে এর নামে মোটা
অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সেই টাকা থেকে
যেসব ডাক্তার, নার্স ও দালাল রোগী পাঠাচ্ছে, তাদের
জন্য থাকছে নির্ধারিত কমিশন। ফলে সরকারি
স্বাস্থ্যনীতির তোয়াক্কা না করে নানা অনিয়মের মধ্যে
পরিচালিত বেসরকারি মালিকানাধীন এসব
প্রতিষ্ঠান বর্তমানে পরিণত হয়েছে চিকিৎসার
নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার
বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল। খোদ ডাক্তাররাও এসব ক্লিনিক
ও ডায়াগনস্টিক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন।
সিভিল সার্জন ও সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষের রহস্যজনক
নিরবতায় ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্লিনিকগুলো পরিনত
হয়েছে চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ
হাতিয়ে নেওয়ার বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল। সরকারী
হাসপাতলে ভাল চিকিৎসা সেবা থাকলেও রোগীরা
এসব অপচিকিৎসা কেন্দ্রস্থল গুলোতে চলে যাচ্ছে
দালালের হাত ঘুরে। তাছাড়া সরকারী হাসপাতালের
কমিশন লোভী চিকিৎসকরা ও অবৈধ অর্থের লোভে
রোগীদের পাঠিয়ে দিচ্ছে তাদের নির্ধারিত
বেসরকারী ক্লিনিক গুলোতে। রোগী পাঠিয়ে
ক্লিনিক মালিকদের কাছ থেকে চলছে মোটা অঙ্কের
কমিশন আদায়ের কাজ। আর এ কাজে সহযোগীতা
করে থাকেন হাসপাতালের কিছু অসাধু ডাক্তার,
নার্স এবং ওয়ার্ড বয়। আর এসব দালালদের আশ্রয়
প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন বিএমএর অবৈধ অর্থ লোভী
কিছু নেতা প্রকৃতির লোক ও স্থানীয় প্রভাবশালী
কিছু চক্র । অবৈধ অর্থের বিনিময়ে বিএম এ এর
নেতা ও প্রভাবশালীরা সকল প্রকার দূর্নীতির পক্ষে
অবস্থান নেয়। এই সকল বিষয় তুলে ধরে হাসপাতালের
চিকিৎসক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও দালালদের বিরুদ্ধে
কোন সংবাদ প্রকাশ করা মাত্রই ঐসব নেতারা ফোনে
নানান তদবীর এবং বিভিন্ন ভাবে ম্যানেজ করার
অপচেষ্টা শুরু করেদেন। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে,
জেনারেল হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে ও
আশপাশ এলাকায় গড়ে উঠেছে ১০ থেকে ১২টি
ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিক। এর
মধ্যে রয়েছে, রেনেসাঁ ডায়াগনস্টিক সেন্টার,
মেডিল্যাব ডায়াগনস্টিক সেন্টার, লাইফ
ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মডার্ন ডায়াগনস্টিক
সেন্টার, নিউ পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার,
স্বপ্ননীড় ডায়াগনস্টিক সেন্টার, এ প্লাস
ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আমেনা মোল্লা ক্লিনিক ও
ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মডার্ন ক্লিনিক, ডক্টরস
ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, স্কয়ার
ডায়াগনস্টিক সেন্টার, এ আর ক্লিনিক অ্যান্ড
ডায়াগনস্টিক সেন্টার সহ বিভিন্ন ক্লিনিক ও অপর
দিকে জেনারেল হাসপাতালের শয্যা সংকট ও
চিকিৎসাসেবায় অব্যবস্থাপনার সুযোগে অনেক
রোগীকে দালালদের প্ররোচনায় স্বজনরা হাসপাতাল
থেকে বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যায় জানা
গেছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাধারণ জ্বর
বা পেট ব্যথা নিয়ে কোনো রোগী হাজির হলেও
কয়েক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে
তাদেরকে।
এসব প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত পুরুষ ও মহিলা দালালরা
প্রতিদিন সকাল থেকে সরকারি হাসপাতালে গিয়ে
প্রতিটি ডাক্তারের রুমে ও রুমের এর বাইরে অবস্থান
করতে দেখা যায়। তাদের কাজ হলো সরকারি
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের
ফুসলিয়ে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া।
সরেজমিনে অনুসন্ধান করে আরো দেখা গেছে,
মুন্সীগঞ্জ জেলার সদর হাসপাতালের সামনের রুটে
অসংখ্য বেসরকারী ক্লিনিকের মালিকেরা ভাল নামি-
দামি এম,বিবিএস ডাক্তারদের নামের তালিকা দিয়ে
বড় সাইনবোর্ড লাগিয়ে রেখেছে। এসব সাইন
বোর্ডের মাধ্যমে রোগীদের দৃষ্টি অন্য দিকে
ঘুরানোর চেষ্টা করলেও মূলত এসব প্রতিষ্ঠান গুলো
চলছে অদক্ষ হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে। ক্লিনিক গুলোতে
এমবিবিএস ডাক্তার ও ডিপ্লোমাধারী প্রশিক্ষিত
নার্স থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তার কোন
প্রতিফলন নেই। মূলতঃ এসব ক্লিনিকগুলো চলছে
সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারদের কারনে। স্থানীয় সূত্রে
জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জ সরকারী জেনারেল হাসপাতাল
থাকা সত্তে ও এক শ্রেনীর অর্থ লোভী ডাক্তার ও
প্রভাবশালী ব্যক্তিরা গড়ে তুলেছে একাদিক বেসরকারী
ক্লিনিক, ডায়াগনোষ্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল
ল্যাবসহ বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার নামে ব্যবহিত
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। রোগীরা বাধ্য হয়ে এসব
প্রতিষ্ঠানে ছুটে চলছে চিকিৎসার জন্য। আর এ
কাজে সহযোগীতা করে থাকেন এক শ্রেনীর দালাল
চক্র। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের মিথ্যা প্রচারনা ও উন্নত
চিকিৎসার প্রলোভনে পড়ে রোগীরা জীবন
বাঁচানোর প্রয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে
উল্টো মৃত্যু মুখে পতিত হচ্ছে। ক্লিনিকের অদক্ষ
হাতুড়ে ডাক্তাররা রোগীদের কাছ থেকে চিকিৎসার
নামে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। সরকারী
হাসপাতালের সামনে গড়ে উঠা এসব ক্লিনিকগুলো
মূলত মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের রোগীদের উপর
নির্ভর করে চলে। এসব ক্লিনিকগুলোতে নেই কোন
পর্যাপ্ত ডাক্তার। গাইনী রোগীদের বসিয়ে রেখে
সরকারী ডাক্তার ডেকে এনে করানো হচ্ছে
আল্ট্রাসোনগ্রাম। সন্ধার পর আর এসব ক্লিনিকে
কোন ভাল ডাক্তার মিলেনা। আর ডায়াগনোষ্টিক
সেন্টারগুলো অধিকাংশ বিকাল ৫ টার পর বন্ধ হয়ে
যায়।এসব চিকিৎসালয় কেন্দ্র গুলোতে যেমন
প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদি নেই তেমনি
মানা হচ্ছেনা স্বাস্থ্যনীতিমালাও । ক্লিনিক ও
ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারগুলো বৈধ কাগজ পত্র
জোগাড় করলেও অন্যক্ষেত্রে সব ফকফকা। এসব
চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো কমিশনলোভী চিকিৎসক
আর দালালদের উপর নির্ভর করে চলছে সব সময়। দালালরা
ফুঁসলিয়েরোগী ক্লিনিকে পাঠালেই পেয়ে যাচ্ছে
কমিশন। পল্লী অঞ্চলের রোগীদের সূত্রে জানা
গেছে,বিভিন্ন গ্রাম্য পল্লী চিকিৎসক,
ফার্মেসির সার্টিফিকেট বিহীন হাতুড়ে
ডাক্তাররাই দালাল হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে। এরাই
রোগীদের মনে ভয় আতঙ্ক সৃষ্টি করে এসব
ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসা করার পরামর্শ দিয়ে
থাকে। এছাড়া এসব ডায়াগনোষ্টিক
সেন্টারগুলোতে পরীক্ষার রিপোর্ট কোন অপারেশনের
কাজে আসেনা বলেও রয়েছে ব্যাপক অভিযোগ। এসব
ক্লিনিকের করা রিপোর্টের উপর কোন চিকিৎসক
সহজে নির্ভর করেনা। তাছাড়া কমিশন লোভী
চিকিৎসকরা শুধু নামে মাত্র রিপোর্ট করালেও রোগীরা
রিপোর্ট নিয়ে গেলে সহজে দেখেনা। অপারেশন
করানোর জন্য রোগীদেরকে ঢাকা- নারায়নগঞ্জ থেকে
পূনরায় রিপোর্ট করাতে হয়। এসব ক্লিনিকে
নিয়মিত কোন এম,বিবিএস ডাক্তার থাকেনা। নেই
কোন ডিপ্লোমাধারী নার্সও। দরিদ্র পরিবারের
অল্পশিক্ষিত সুন্দরী মেয়েদের নার্সের পোশাক পড়িয়ে
চালাচ্ছে কার্যক্রম। সদর জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে
জানা গেছে, সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসকগন
হাসপালের ভিতরেই ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারের
দালালদের সহযোগিতায় প্রাইভেট রোগী দেখেন
মোটা অংকের ভিজিট নিয়ে। যেসব ডায়াগনোষ্টি
সেন্টারে হাসপাতালের ডাক্তাররা প্রাইভেট চেম্বার
করে সেসব ডায়াগনোষ্টিক ও ক্লিনিকের দালালদের
চিকিৎসরাই নিজেদের স্বার্থে রুমে বসিয়ে রাখে।
আর কমিশন লোভী এসব চিকিৎসকরা প্রতিটা
ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারের নিয়োজিত দালালদের
হাতে রোগীদের তুলে দেয় পরীক্ষা নিরিক্ষা করানোর
জন্য। দেখা গেছে বহি: বিভাগের চিকিৎসকরা সকল
ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারের মালিকদের মন রক্ষা করে চলে
। চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসাকারী এসব
ক্লিনিক কমিশন লোভী চিকিৎসকদের ও ব্যাপারে
সিভল সার্জন ও স্থানীয় প্রসাশনসহ সংশি¬ষ্ট
কর্তৃৃপক্ষের কোন মাথা ব্যাথা নেই। তাদের
রহস্যজনক নিরবতার কারনে এসব ক্লিনিক সেবার
নামে বানিজ্য করে যাচ্ছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী
সাধারাণ মানুষ । এ বেপারে
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী রিমা
বেগম অভিযোগ করে বলেন,এসব ডাক্তারের কাছে
গেলেই বাধ্যতা মুলক রক্ত, প্র¯্রাব
আলট্রাসনোগ্রাম, এক্সরে পরীক্ষা করার পরামর্শ দেয়।
ডাক্তাররা প্রেসকিপশনে ঔষধ না লিখে আগে লিখে
পরীক্ষা নিরিক্ষা করার কথা লিখেন, লিখা শেষ হলেই
টিকেটটি রোগীর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে যায়
দালালরা। আর ডাক্তারা ও বলে এর সাথে আর ওর সাথে
গিয়ে রিপোর্টটি করে নিয়ে আসুন।
আরেক রোগী বাচ্চু বেপারী জানান, এসব
ডায়াগনোষ্টিক ও ক্লিনিকের পরীক্ষার রিপোর্টের
উপর ভরসা করে অপারেশন হয়না। যে কোন অপারেশনের
জন্য ঢাকা ও নারায়নগঞ্জ থেকে পূনরায় রিপোর্ট করে
আনতে হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা বলতে তেমন
কিছু নেই। ওখানে গেলে চিকিৎসকের ফি আর এক
ডজন পরীক্ষা নিরিক্ষা করানো ছারা আর কোন কাজ
নেই এই ধরনের নি¤œ মানের ক্লিনিক ও
ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারগুলোর প্রতারনার কারনে
গ্রাম থেকে আসা রোগীরা হারাচ্ছে তাদের নগদ
অর্থ ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ
সিদ্দিকুর রহমান বলেন, হাসপাতালে ছদ্মবেশে দালাল
ঘুরে বেড়ায় এটা ঠিক। আমরা কয়েকদিন আগেও
একজন মহিলা দালালকে ধরে থানায় দিয়েছি।
রোগীদের ভিড়ে দালাল চিহ্নিত করতে একটু সমস্যা
হচ্ছে। তবে খুব শিগ্রই হাসপাতালের ভিতরে এবং
বাইরে সিসি ক্যামেরা লাগানো হবে। স্থানীয়
রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ সকলের স¤িœলিত প্রচেষ্টা
ছাড়া হাসপাতাল দালাল মুক্ত করা সম্ভব নয়। ক্লিনিক ও
ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারের বিষয়ে তিনি বলেন,
মুন্সীগঞ্জ শহর ও এর আশপাশ এলাকার ক্লিনিক ও
ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারগুলোকে নজরদারিতে
রেখেছি। খুব শিঘ্রই এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নেয়া হবে। #
শুভ ঘোষ।
মুন্সীগঞ্জ জেলা