মোঃ রুহুল আমীন, আত্রাই প্রতিনিধি
নওগাঁর আত্রাই উপজেলার নৃ-গোষ্ঠী ৬টি পরিবারের সদস্যদের কেউ তাদের
খোঁজ খবর রাখে না। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মানুষেরা রয়েছে সরকারের দৃষ্টির
অন্তরালে। সরকার যায়, সরকার আসে কিন্তু ক্ষুদ্র এ নৃ-গোষ্ঠীর ভাগ্যের
কোন পরিবর্তন হয় না। ফলে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর আজও ক্ষুদ্র নৃ-
গোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আর্থ সামাজিক উন্নয়নে অবহেলিত এবং
পিছিয়ে রয়েছে। এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের সদস্যরা অর্ধহারে,
অনাহারে, অভাব,অনটন, রোগ-শোকসহ নানা সংকটে মানবেতর জীবন-
যাপন করছে। অভাব, অনটন, দুঃখ-দুর্দশা আর হতাশাই যেন এ ক্ষুদ্র নৃ-
গোষ্ঠী পলী মানুষের নিত্য দিনের সঙ্গী।
আত্রাই উপজেলার একমাত্র পারকাসুন্দা গ্রামের ৬টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী
পরিবারের বসবাস রয়েছে। যারা স্থানীয় ভাবে ‘বুনো‘ সম্প্রদায় নামে
পরিচিত। এদের মধ্যে ৭০ ভাগ পরিবার দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস
করছে। শিক্ষায় পশ্চাৎপদতার কারনে তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও
সামাজিক কর্মকান্ড থেকে পিছিয়ে রয়েছে।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে ভারতের নাগারল্যান্ড রাজ্যেও
নাগদপুরের মালো সম্প্রদায়ের শতাধিক লোক প্রথমে রাজশাহীর কাকন
হাট-শীতলাই এবং পরবর্তীতে নওগাঁর আত্রাইয়ে আসে। লর্ড
ডালহৌসির আমলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নীল চাষ সম্প্রসারণের জন্য
তাদের আত্রাইয়ে নিয়ে আসে। তারা তখন আত্রাই উপজেলার পারকাসুন্দা,
কোলা, বিপ্রো বোয়ালিয়া, থাওইপাড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।
১৯৪৭ সালে আবার অনেকেই এ দেশ ত্যাগ করে নিজ ভ’মিতে ফিরে যান।
বর্তমানে এখন শুধু আত্রাইয়ের পারকাসুন্দা গ্রামে ৬/৭ টি পরিবার
বসবাস করছে। তারা এখনও দারিদ্রতার কষাঘাতে অতিকষ্টে দিন
কাটাচ্ছেন।
সরেজমিনে উপজেলার পারকাসুন্দা গ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর
লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, এদের অধিকাংশ পরিবার নানা
সমস্যায় জর্জরিত। তারা মাটির দেয়াল ঘরের উপরে পলিথিন দিয়ে তৈরি
ছাপড়া ঘরে রাতের বেলা কোন মতে মাথা গোঁজার চেষ্টা করছে। তাদের
নেই কোন স্বাস্থ্য সম্মত ল্যাট্রিন, বিশুদ্ধ পানি সহ অন্যান্য নাগরিক
সুযোগ-সুবিধা। এ পলীতে লাগেনি আধুনিকতার কোন ছোঁয়া। ওই
পলীতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে যায় জীর্ণশীর্ণ দেহ নিয়ে মাটির
তৈরী ছাপড়ার সামনে বসে আছে এক বৃদ্ধা নারী। কাছে গিয়ে তার
সাথে আলাপ করতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে। ৬৫ বছর বয়সী অপর এক
বিধাবা নারী শান্তি রায়ের সাথে কথা বললে তিনি জানান, তার স্বামী
১০ বছর আগে মারা গেছেন। অন্যের জায়গায় মাটির দেওয়ালের উপর
পলিথিনের ছাউনী দিয়ে বসবাস করছে। অন্যের জমিতে শ্রম বিক্রি করে
যা পায় তা দিয়ে কোন মতো তাদের সংসার চলে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী
সম্প্রদায়ের খিনখিনে সাদা মাটা এক যুবক রবি রায় আমাদের সময়কে
জানান, তাদের মধ্যে অনেকের জমি বেদখল হয়ে গেছে। শিক্ষা না থাকায়
সমাজের কাছে তারা আজ অবহেলিত। তারা আইনী সহায়তা থেকেও
বঞ্চিত হচ্ছে। এদের মধ্যে শতকরা ৯৫ জনের কোন জমিজমা নেই। অনেকের
কাগজ-কলমে থাকলেও বাস্তবে তা নেই। এ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা
খুব সহজ সরল ও সাদা সিঁধে জীবন যাপন করে। ফলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা
এক সময় ভালো থাকলেও এখন দিন মুজুর আর ভূমিহীনে পরিনত হয়েছে।
পথে বসেছেন অনেকে মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে টাকা নিয়ে
জড়িয়ে পড়েছে ধার দেনার জালে। আবার এদের মধ্যে অনেকে অত্যাচারিত
হয়ে দেশ ত্যাগ ও করেছেন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী-পুরুষেরা জঙ্গলে জঙ্গলে
ঘুরে এক সময় বেজী, ইদুর, পাখি, খরগোশ, কচ্ছপসহ নানা ধরনের
প্রাণী শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো। এখন বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে
যাওয়ায় তাদের জীবিকাও বন্ধ হয়ে গেছে।