শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৭:৩৭ পূর্বাহ্ন

নরসিংদীতে ডিসি-আ. লীগ মুখোমুখি!

বাংলার প্রতিদিন ডেস্ক ::
  • আপডেট সময় বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৬
  • ১১৫ বার পড়া হয়েছে

নরসিংদী প্রতিনিধিঃ

নরসিংদীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবু হেনা মোরশেদ জামান ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন। নেতাকর্মীরা ডিসির বিরুদ্ধে ক্রমাগত দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে তাঁর অপসারণের দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করছেন।

আর ডিসি তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে নিজের ফেসবুক পেজে জবাব দিচ্ছেন। গত ২১ নভেম্বর সোমবার তিনি লিখেছেন, ‘কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে পায়, তাই বলে কি কুকুরে কামড়ানো মানুষের শোভা পায়’ (ছোটবেলায় পড়া কবিতার চরণ কেন যে মনে পড়ল আজ)।

ওই দিন ডিসির অপসারণ চেয়ে তাঁর কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেছিলেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ওই দিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ডিসির বিরুদ্ধে অশ্লীল ভাষায় বিভিন্ন স্লোগান দেন। একজন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্লোগানের ভাষা শুনে হতবাক হয়ে যান প্রশাসনের কর্মীরা। এতে কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও জেলা প্রশাসন। জেলার স্বাভাবিক কার্যক্রমে গতি হারাচ্ছে। পরস্পরকে দোষারোপ করে সরকারের সর্বোচ্চ মহলে চিঠি চালাচালি চলছে বলেও জানা গেছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়ার দাবি, গত ইউপি নির্বাচনে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করেছেন জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান। তিনি নৌকা প্রতীকের সমর্থকদের মাঠে নামতে দেননি।

এক বাক্যে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান।

ডিসিকে নাগরিকত্ব দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা!

জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই বছর আগে ২০১৪ সালের ২৬ জুন ফরিদপুর জেলা থেকে নরসিংদীতে যোগ দেন ডিসি আবু হেনা মোরশেদ জামান। ওই সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

গত ২৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় নরসিংদী ক্লাব লিমিটেডের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জনপ্রতিনিধিরা ডিসিকে নরসিংদীর নাগরিকত্ব দিতে চান। প্রধান অতিথির বক্তব্যে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নরসিংদী-১ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বীরপ্রতীক ডিসিকে একজন অত্যন্ত মেধাবী, সৎ ও ভালো মানুষ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আবু হেনা মোরশেদ জামান সরকারের প্রতিটি কাজ অত্যন্ত সুন্দর ও চমৎকারভাবে করেন। নরসিংদীর মানুষ তাঁকে ভালোবাসে এবং তিনিও নরসিংদীকে ভালোবাসেন। আমরা তাঁকে নরসিংদীর নাগরিকত্ব দিতে চাই।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নরসিংদী-৪ (মনোহরদী-বেলাব) আসনের সংসদ সদস্য নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন, জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান শিক্ষা সংস্কৃতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন।

কিন্তু গত ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনের পর থেকে পাল্টে যেতে থাকে সুসম্পর্কের বাতাস। বইতে থাকে উল্টো হাওয়া। কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জেলার ৬১টি ইউনিয়নের সাতটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও একটিতে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হন। এর মধ্যে সদর উপজেলার শীলমান্দি ইউপিতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে পরাজিত করেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল বাকীর। হাজিপুর ইউপিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে হারিয়ে  নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ইউসুফ খান পিন্টু বিজয়ী হন। এই দুটি ইউনিয়নের নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে প্রকাশ্যে জাল ভোট, কেন্দ্র দখলসহ নানা অভিযোগ ওঠায় পরবর্তী দফার নির্বাচনে কঠোর অবস্থান নেয় নির্বাচন কমিশন ও জেলা প্রশাসন। ফলে নির্বাচনের ফলাফল ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে যায়। এই নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দূরত্ব শুরু হয়। শিবপুরের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স উদ্বোধন অনুষ্ঠান বাতিল করাকে কেন্দ্র করে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বিরোধ আরো তুঙ্গে ওঠে।

ডিসির গোপন প্রতিবেদন!

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামানের একটি গোপন প্রতিবেদন ফাঁস হয়ে যায়। প্রতিবেদনে নরসিংদীর পৌরসভার মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুজ্জামান কামরুলসহ একাধিক নেতার বিরুদ্ধে তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নরসিংদীর ছয়জন সংসদ সদস্যের মধ্যে নরসিংদী-৩ (শিবপুর) আসনের সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, নরসিংদী-২ (পলাশ) আসনের কামরুল আশরাফ খান পোটন, নরসিংদী-৫ (রায়পুরা) আসনের এমপি ও সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, সংরক্ষিত আসনের এমপি বেগম রহিমা আক্তার এবং জেলা পরিষদের প্রশাসক আসাদুজ্জামানসহ আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা বর্তমানে আওয়ামী লীগের অপরাজনীতির শিকার।

এই প্রতিবেদন ফাঁস হওয়ার পর প্রশাসনের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বে থাকা নেতাদের বিরোধ অনেকটা প্রকাশ্য রূপ নেয়।

এরই জের ধরে গত ২৭ সেপ্টেম্বর দলীয় সভায় জেলা প্রশাসনের কোনো কার্যক্রমে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জেলা পূজা উদযাপন কমিটির নেতারা জেলা প্রশাসককে বর্জন করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ নভেম্বর দুদকের গণশুনানিতে জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে এলআর ফান্ড, সরকারি জমি বরাদ্দ ও মায়ের নামে রোকেয়া পদকের নাম প্রস্তাবসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলেন মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল ও আওয়ামী লীগের নেতারা। গত সোমবার ডিসির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ঘেরাও করে কার্যালয়ের ফটক।

একই দাবিতে গতকাল মঙ্গলবারও বিক্ষোভ করেন স্থানীয় নেতারা। পরে সাতদিনের মধ্যে জেলা প্রশাসককে অপসারণের সময় বেঁধে দেন উপস্থিত নেতারা। এ সময় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভেতরে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নেয়। মারমুখী অবস্থার সৃষ্টি হলে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

আওয়ামী লীগের নেতারা যা বললেন

নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন বাচ্চু ডিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেন, অস্তিত্ববিহীন ‘ক্যান্ডেল লাইট স্কুলের’ নামে ডিসি নামমাত্র মূল্যে প্রায় এক একর জমি ইজারা দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন। তাঁর চাপে সহকারী কমিশনার (ভূমি) খাসজমি বন্দোবস্তের প্রস্তাব পাঠান। মাধবদীতে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে ২ শতাংশ জমি ভূঁইয়া গ্রুপকে নামমাত্র মূল্যে ইজারা দেন। নদীর জমি ইজারা দেওয়ার এখতিয়ার তাঁর নেই। বিদায়ী অতিরিক্ত জেলা  প্রশাসক (রাজস্ব) কামাল হোসেন পদোন্নতি পেলেও ডিসি তাঁকে এক বছর ধরে রেখে  লুটপাট করেছেন। এলআর ফান্ডের টাকা কোথায় খরচ করে তা কেউ জানে না।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া বলেন, জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান ক্রীড়া সংস্থাসহ প্রশাসনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিএনপি জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক মঞ্জুর এলাহীকে নিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম করেন। মন্ত্রী, এমপি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের ডাকেন না। তাঁদের সঙ্গে অসদাচরণসহ দুর্ব্যবহার করে থাকেন। উনি আমাদের মেয়র কামরুজ্জামানকে কটাক্ষ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে কে বাদ পড়েছে তা নিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন। জেলা প্রশাসক হয়ে তিনি তো এসব মন্তব্য করতে পারেন না। তা ছাড়া দুদকের গণশুনানিতে জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। আমি দুদক চেয়ারম্যানের কাছে এসব বিষয় তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই। শুধু তাই নয়, তাঁর এসব দুর্নীতির ফাঁস হয়ে যাওয়ায় নরসিংদীর সাধারণ মানুষও তাঁকে আর চায় না। তাই তার অপসারণ প্রয়োজন।

জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার কোনো ধরনের দূরত্ব নেই। কেউ যদি আমার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে থাকেন, সেটা তাঁদের ব্যাপার। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী আমার দায়িত্ব আমি শতভাগ সততার সঙ্গে পালন করে গেছি।  সরকারের কোনো নীতিমালা, আইন, প্রজ্ঞাপন বা এখতিয়ার বহির্ভূত কোনো কাজ করিনি।’

জেলা প্রশাসক আরো বলেন, ‘আমি ভুল করলে তদন্তেই তা প্রমাণিত হবে। আর রোকেয়া পদক জেলা ভিত্তিক কোনো পদক নয়, সারা বাংলাদেশে দুজন নারীকে দেওয়া হবে। আর নরসিংদী থেকে নির্বাচক বোর্ড যার নাম প্রস্তাব করেছে তিনি আমার মা। কিন্তু জেলা প্রশাসকের মা হিসেবে নয়, কর্মগুণের কারণেই নির্বাচক বোর্ড তাঁর নাম প্রস্তাব করেছে

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © banglarprotidin.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themebazarbanglaro4451