সোমবার, ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:০১ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

চিকিৎসায় অবহেলা, খতনায় শিশু মৃত্যুতে শঙ্কিত মা-বাবারা

বাংলার প্রতিদিন ডেস্ক ::
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ৮ বার পড়া হয়েছে

খতনার মতো ছোট অস্ত্রোপচার (শর্ট কেস) নিয়ে এখন দেশজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে পাঁচ বছরের শিশু আয়ান ও স্কুল শিক্ষার্থী আয়হামের মৃত্যুর পর অভিভাবক ও স্বজনরা সন্তানদের খতনা নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। সরকারি চাকরিজীবী, ব্যাংকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, চিকিৎসক দম্পতিসহ ভিন্ন ভিন্ন পেশার অন্তত ১০ অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলেছেন কালবেলার এ প্রতিবেদক। যারা খতনার অস্ত্রোপচার নিয়ে আতঙ্কের কথা জানিয়েছেন। অনেকে আবার প্রাচীন পদ্ধতিতে (হাজাম দিয়ে) খতনা করানোরও ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

উচ্চশিক্ষায় বিদেশ গমনেচ্ছুদের নিয়ে কাজ করেন আনিছুর রহমান। পাঁচ ও দুই বছরের দুই পুত্রসন্তানের জনক তিনি। মতিঝিলের বাণিজ্যিক এলাকায় তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গতকাল দুপুরে কথা হয় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি জানান, সন্তানের সুন্নতে খতনা করাতে তিনি ভয় পাচ্ছেন। আয়ান ও আয়হামের মৃত্যু তার মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। রাজধানীর শনিরআখড়ায় দুই সন্তান ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে সস্ত্রীক তার বসবাস। তিনি আরও বলেন, ঢাকায় নামিদামি হাসপাতালে সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে মৃত্যু হলো দুই শিশুর।

এখন নিজের সন্তানদের খতনা হাসপাতালে করাতে ভয় হচ্ছে। মনে হয় গ্রামে নিয়ে হাজাম (গ্রামে যারা খতনা করান) দিয়ে সন্তানের খতনা করানোই ভালো। আমাদের সময়ে তো খতনা করাতে গিয়ে মৃত্যু হয়নি। এখন হাসপাতালে কেন মারা যায়?

একই আতঙ্ক মিরপুরের শ্যাওড়াপাড়ার বাসিন্দা আরিফুর রহমানের। পুরানা পল্টন এলাকার একটি প্রথম শ্রেণির সরবরাহকারী (ঠিকাদারি) প্রতিষ্ঠানে তিনি কর্মরত। এ প্রতিবেদককে জানান, মুসলমানির (খতনা) মতো ছোট কাজে শিশুদের কেন মৃত্যু হয়? তাহলে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন হলো কোথায়? এর চেয়ে তো গ্রামে যারা মুসলমানি করান, তাদের দিয়ে করানোই ভালো। তারা শিক্ষিত না হয়েও নিরাপদে মুসলমানি করাচ্ছেন। আমি এখন দুই বছরের পুত্র শুভর মুসলমানি করাতে ভয় পাচ্ছি।

সাঁতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মালিবাগ জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে দুই শিশুর মৃত্যুর পর দেশের অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দুই শিশুর মৃত্যুর পর হাসপাতাল দুটি বন্ধ করে দায় এড়িয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একাধিক বিশেষজ্ঞ কালবেলাকে জানান, ছোট অস্ত্রোপচারে সার্জনরা অবহেলা করেন। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে নেই অভিজ্ঞ অ্যানেসথেসিওলজিস্ট। আর যেখানে আছেন, সেখানে হয়তো অবহেলা রয়েছে তাদের। আবার ওষুধেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। শিশুদের কেন বারবার মৃত্যু হচ্ছে, এসব নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত হওয়া দরকার। তারপর একটি গাইডলাইন তৈরি করা হলে শিশুদের মৃত্যু ও অভিভাবকদের আতঙ্ক দূর করা সম্ভব হবে।

এদিকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়হামকে সুন্নতে খতনা করাতে নিয়ে যান তার বাবা ফখরুল আলম। স্থানীয় অ্যানেসথেসিয়া না দিয়ে ফুল অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করা হয় শিশুটির শরীরে। এতে খতনা করানোর পর আর জ্ঞান ফেরেনি শিশুটির। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও সন্তানকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের না করায় তিনি নিজেই অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করেন। গিয়ে দেখেন সন্তানের নিথর দেহ পড়ে আছে। নাক ও মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। এরপর ফখরুল আলমকে ওটি থেকে বের করে দেন চিকিৎসকরা। দুই ঘণ্টা পরে জানানো হয় আয়হামের মৃত্যু হয়েছে। পরে হাতিরঝিল থানায় চিকিৎসায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে মামলায় জেএস হাসপাতালের তিন চিকিৎসককে আসামি করা হয়। চিকিৎসক দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদালতে তোলা হলে জেলগেটে দুই চিকিৎসককে জিজ্ঞাসাবাদেরও নির্দেশ দেন আদালত। দোষী সাব্যস্ত হলে দুজনের শাস্তি হলেও সন্তান হারানো বাবা-মা কি আর তাদের সোনার মানিক ফিরে পাবেন? এ ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক নোটিশে জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারের তিন চিকিৎসক ডা. ইশতিয়াক আজাদ, ডা. মাহবুব মোর্শেদ ও ডা. এস এম মোক্তাদিরের বিষয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারকে অনুরোধ করে। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল পরিচালনায় নতুন করে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়োজিত সব চিকিৎসকের পেশাগত ডিগ্রির সনদ, বিএমডিসির হালনাগাদ নিবন্ধন ও নিয়োগপত্রের কপি অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে।

হাসপাতাল, ক্লিনিকের ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের অপারেশন বা প্রসিডিউরের জন্য অবশ্যই রেজিস্টার্ড চিকিৎসককে সার্জনের সহকারী হিসেবে রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই লাইসেন্সপ্রাপ্ত বা নিবন্ধিত হাসপাতাল ও ক্লিনিক ছাড়া চেম্বারে অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অ্যানেসথেসিয়া প্রদান করা যাবে না। বিএমডিসি স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ ছাড়া যে কোনো ধরনের অপারেশন/সার্জারি/ ইন্টারভেনশনাল প্রসিডিউর করা যাবে না। সব বেসরকারি নিবন্ধিত লাইসেন্সপ্রাপ্ত হাসপাতাল, ক্লিনিকে লেবার রুম প্রটোকল অবশ্যই মেনে চলতে হবে। নিবন্ধিত বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত হাসপাতাল, ক্লিনিকে অপারেশন থিয়েটারে অবশ্যই অপারেশন থিয়েটার শিষ্টাচার মেনে চলার নির্দেশনাসহ ১০টি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

এর আগে গত ডিসেম্বরে সাঁতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঁচ বছরের শিশু আয়ানকে খতনা করাতে নিয়ে আসেন তার বাবা। খতনা করানোর সময় অতিরিক্ত অ্যানেসথেসিয়ার কারণে আর জ্ঞান ফেরেনি শিশু আয়ানের। পরে গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। শেষ পর্যন্ত আর রক্ষা হয়নি। আট দিন অচেতন থাকার পর গত ৭ জানুয়ারি রাতে মৃত ঘোষণা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের সাবেক চিকিৎসক ফজলুর রহমান কালবেলাকে বলেন, অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর যত দুর্ঘটনা ঘটে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে শর্ট কেসের (ছোট অপারেশন) ক্ষেত্রে, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ও সার্জনরা অবহেলা করেন। বিশ্বজুড়ে এখন অ্যানেসথেসিয়া এত অ্যাডভান্স হয়েছে, তার পরও আমাদের দেশে শিশুরা কেন মারা যাচ্ছে। আমার গত ৩৯ বছরের ক্যারিয়ারে দেখেছি, অনেক সময় সার্জন অ্যানেসথেসিওলজিস্টকে ডাকারও প্রয়োজন মনে করেন না। তারা হয়তো নিজেরাও ছোট কেসের ক্ষেত্রে অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করে থাকেন। অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর রোগীকে প্রোপার মনিটর করা হয় না। যেমন ১৫ থেকে ২০ মিনিটের ছোট অপারেশনের ক্ষেত্রে অ্যানেসথেসিওলজিস্টও মনিটর করেন না। অথচ সারা বিশ্বে যদি বছরে ভুল অ্যানেসথেসিয়ায় ৫ হাজার মানুষেরও মৃত্যু হয়, সেখানে দেখা যাবে সাড়ে চার হাজারই ছোট কেস আর অবহেলায় মৃত্যু। বাচ্চাদের অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর চেকআপ করতে হয়। বারবার অবজারভেশন করতে হয়। কেন মৃত্যু হচ্ছে—এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া দরকার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, সুন্নতে খতনায় অ্যানেসথেসিয়া খুবই সিম্পল বিষয়। দুই শিশুর মৃত্যুর পর এখন খতনা নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। শিশুদের মৃত্যুর পেছনে অ্যানেসথেসিওলজিস্টের অবশ্যই কর্তব্যে ঘাটতি রয়েছে। খতনার মতো ছোট অস্ত্রোপচারে কেন দুর্ঘটনা ঘটছে, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। যে ওষুধ বাচ্চাদের প্রয়োগ করা হচ্ছে, সেখানে হয়তো সমস্যা থাকতে পারে। ওষুধের কেমিক্যাল অ্যানালাইসিস করা দরকার। ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ জানা দরকার। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার কারণ যদি হয় হার্ট অ্যাটাক বা শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু। তাহলে দেখতে হবে অ্যানেসথেসিয়ার ওষুধ বাচ্চাদের হার্টের জন্য ক্ষতিকর কি না কিংবা শ্বাসতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর কি না। অ্যানেসথেসিয়ার যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক কাজ করেছে কি না কিংবা সেখানে থাকা অক্সিজেন ঠিক ছিল কি না। এসব তদন্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিএমডিসির তদন্ত সাপেক্ষে একটা সুপারিশ থাকা দরকার। তাহলে হয়তো শিশুদের মৃত্যু ও অভিভাবকদের ভীতি দূর করা

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © banglarprotidin.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themebazarbanglaro4451