বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২৬ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

ভাঙনের মুখে কমলনগরের ১৫ কিলোমিটার এলাকা লক্ষ্মীপুরের মানচিত্র থেকে মুছে যেতে পারে রামগতি ও কমলনগর

বাংলার প্রতিদিন ডেস্ক ::
  • আপডেট সময় রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৬
  • ২৪৬ বার পড়া হয়েছে

 

 

 

 

 

 

lakshmipur komal nagor-p 2

জাকির হোসেন পাটোয়ারী, রামগতি/কমলনগর থেকে ফিরেঃ

গত কয়েক বছর ধরে মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে লক্ষ্মীপুরের রামগতি

ও কমলনগর উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদ। এরই মাঝে তলিয়ে গেছে দুই উপজেলার হাজার

হাজার বসতবাড়ি, ফসলী জমি, হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ ৩৮ কিলোমিটার বেড়ি বাঁধ। সকল সরকারী

প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও তবুও ভাঙন থামছে না। দিন দিন ভাঙ্গনের তীব্রতা বেড়েই

চলছে।

লক্ষ্মীপুরে উপকূলীয় অঞ্চল রামগতি উপজেলার রামগতি বাজার সংলগ্ন মেঘনা নদীর

তীরে শত শত পরিবারের স্বপ্ন আজ মেঘনার অব্যাহত ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নদী

ভাঙ্গনের ফলে কেউ হারাচ্ছে ঘর-বাড়ি, বসত-ভিটা, ফসলের মাঠ, গাছ-পালা, ব্যবসা-

প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাবা-মা’র এমনকি পূর্বপুরুষের

শেষ ঠিকানা (কবর) টুকুও। প্রিয় মানুষের হাসি ও স্বপ্ন আজ রাক্ষুসী মেঘনার

ভাঙ্গনে শেষ হয়ে গেছে। তার পরেও থেমে নেই মেঘনার ভাঙ্গন।

সরেজমিনে রামগতি মাছঘাট এলাকায় গেলে দেখা যায় ভাঙ্গনের ভয়াবহ চিত্র।

বর্তমানে বড়খেরী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি, রামগতি আছিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়,

রামগতি রব্বানিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা, রামগতি বালিকা সরকারি

প্রাথমিক বিদ্যালয়, রামগতির ঐতিহ্যবাহী দায়রা বাড়ি, রামগতি বাজার মেঘনার

ভাঙ্গনের তোপের মুখে। অন্যদিকে বড়খেরী ইউনিয়নের রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়সহ

বেশ কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মেঘনার তীরে। যেন দেখার কেউ নেই!

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী ভাঙ্গনের বিষয়ে নির্বিকার রয়েছেন। এভাবে

চলতে থাকলে এই বর্ষা মওসুমে মেঘনার করাল গ্রাসে দক্ষিণ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী

রামগতি বাজারসহ রামগতির বিশাল এরিয়া বিলীন হয়ে যাবে মেঘনা নদীর বুকে।

এদিকে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চরকালকিনি ইউনিয়নের নাছিরগঞ্জ থেকে

পাটারীরহাট ইউনিয়নের জারিরদোনা পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকায় নদী

ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। এদিকে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এক কিলোমিটার

এলাকায় বাঁধ নির্মাণ কাজের চুক্তি হলেও অজ্ঞাত কারনে তা এখনো শুরু হয়নি।

এতে করে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এলাকাবাসী।

বসতঘরের ২০ থেকে ৩০ ফুট দূরেই মেঘনা নদী। যেকোনো সময় বসতভিটে গিলে

নিতে পারে রাক্ষুসে মেঘনা। সে আতঙ্কে ঘরের টিনের ছাল খুলে নিতে ব্যস্ত

ইদ্রিস আলী (৫৪)। আর আসবাবপত্র সরিয়ে নিচ্ছে তার দুই ছেলে। উঠানের এক

কোণের রান্নাঘরটি বারবার পরখ করছেন তার স্ত্রী রাজিয়া বেগম। একটু আগেও

ওই চুলায় রান্না করেছিলেন তিনি। আর কখনো সে চুলায় হাঁড়ি পাতিল উঠবে

না। হয়তো রাতেই রান্নাঘর বিলীন হবে মেঘনার বুকে!

ইদ্রিস আলীর বৃদ্ধা মা নির্বাক তাকিয়ে আছেন বসতঘরের পাশের স্বামী ও

স্বজনদের কবরস্থানে। দু’একদিনের মধ্যে এ কবরস্থানও গিলে খাবে মেঘনা। গত

বৃহস্পতিবার দুপুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চরফলকন

এলাকায়। স্বজনদের নিয়ে কোথায় আশ্রয় নেবেন এমন প্রশ্নে ইদ্রিস আলী

বলেন, কই আর যাইউম। জায়গা-জমি বেক (সবকিছু) নদী ভাঙ্গি লই গেছে।

আপতত বেড়িবাঁধ এলাকায় থাইক্কুম (থাকবো)। তার মতো এমন অসংখ্য পরিবার

বসতঘর সরিয়ে নিয়েছে। বর্তমানেও হাজারো পরিবার বসত-ঘর সরিয়ে নিচ্ছেন।

প্রসঙ্গত, মেঘনা নদীর ভাঙন রোধে লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর এলাকায় বাঁধ

নির্মাণে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার অনুমোদন করে একনেক। ২০১৪ সালের ৫

আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) প্রথম

পর্যায়ে ১৯৮কোটি টাকার প্রকল্প বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রথম পর্যায়ের বরাদ্দকৃত

টাকায় রামগতিতে এক কিলোমিটার, আলেকজান্ডারে সাড়ে তিন কিলোমিটার

এবং কমলনগরে এক কিলোমিটার বাঁধ বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিলো। গত বছরের ১

ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৯ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন

ব্যাটালিয়ন আলেকজান্ডার এলাকায় সাড়ে তিন কিলোমিটার কাজ বাস্তবায়ন

করছে। যে কারণে ওই এলাকায় নদী ভাঙন প্রতিরোধ হয়েছে। একই সময়ে রামগতি

উপজেলার রামগতি বাজার সংলগ্ন ১ কিলোমিটার ও কমলনগর উপজেলার মাতাব্বর

হাট এলাকায় ১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের কাজ চলতি বছরের প্রথমে শেষ হবার

কথা। কিন্তু সময়ক্ষেপন করে এখনো কাজ শুরুই হয়নি। যথাসময়ে কাজ শুরু না করায়

নির্মাণ কাজে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

রামগতি বাজার ব্যবসায়ী ও রঘুনাথপুর এলাকাবাসী দু:খ প্রকাশ করে বলেন,

আমাদের পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি, দোকানঘর মেঘনার ভাঙ্গন থেকে বোধহয়

শেষপর্যন্ত রক্ষা করা সম্ভব হবে না। যখন বাজার থেকে ট্রলারের শব্দ কানে আসে তখন

নিজেদের বড় অসহায় মনে হয়। যদি সঠিক সময়ে নদীর ভাঙ্গন রোধে সঠিক

নজরদারী করা না হয় তাহলে আমাদের সবকিছু নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। আমরা

সর্বস্বান্ত হয়ে যাবো। আগুনে পুড়লেও কিছু থাকে কিন্তু নদী ভাঙ্গলে কিছুই

থাকে না।

রামগতি আছিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল রাজ্জাক বলেন,

আমাদের বিদ্যালয়ের সামনে মেঘনা নদী চলে এসেছে। প্রতিদিন জোয়ারের পানি

আমাদের স্কুলে প্রবেশ করায় আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনেক শঙ্কিত।

বড়খেরী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (ভার:) মো: হাসিবুল ইসলাম জানান,

আমাদের ফাঁড়ির পুকুর পাড় (৫ আগস্ট) মেঘনা নদীর ভাঙ্গনে ভেঙ্গে যায়। জোয়ারের

পানি ফাঁড়ি পর্যন্ত চলে আসায় আমরা খুবই চিন্তিত।

বড়খেরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ ফেরদৌস ক্ষোভ প্রকাশ করে

বলেন, আমার ইউনিয়নের তিন ভাগের দুই ভাগ ভূমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

রঘুনাথপুর গ্রামের পল্লীমঙ্গল উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদসহ শত

শত মানুষের বসত বাড়ি নদীগর্ভে বিলীনের পথে। বিভিন্ন মহলে রাক্ষুসে মেঘনার

ভাঙন প্রতিরোধের বিষয়ে আলোচনা করেও এখন পর্যন্ত কোন সুফল পাইনি।

আলেকজান্ডার ৩১ শয্যা হাসপাতালের সামনে ভাঙ্গনরোধে যে কাজ করা হচ্ছে তা

যদি আমার ইউনিয়নে দশ ভাগের এক ভাগ করা হতো তাহলে নদী ভাঙ্গনরোধ করা

সম্ভব ছিলো।

কমলনগর উপজেলার চরফলকন ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও নদী ভাঙনরোধ

কমিটির নেতা এএনএম আশরাফ উদ্দিন জানান, মতিরহাট থেকে আলেকজান্ডার

পর্যন্ত প্রায় ১৭ কিলোমিটার এলাকার ২২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ১২টি বাজারসহ

অসংখ্য স্থাপনা মেঘনার ভাঙন মুখে রয়েছে। গত ৭ বছরে ৭টি সাইক্লোন

সেন্টার, ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ১০টি বাজার তলিয়ে গেছে। ভাঙনের কারণে

ভিটেমাটি হারিয়ে হাজার হাজার মানুষ নিঃশ্ব হয়ে পড়ছেন। নদী ড্রেজিং ও

অভ্যন্তরীণ নৌ কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনী, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে

স্বচ্ছভাবে বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

সেনাবাহিনীর মাধ্যমে কমলনগর উপজেলার বাঁধ নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ

কামনা করে নদী ভাঙন রোধ কমিটির সভাপতি ও হাজিরহাট উপকূল ডিগ্রি

কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল মোতালেব জানান, ভাঙনরোধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না

নিলে লক্ষ্মীপুরের মানচিত্র থেকে কমলনগর উপজেলা মুচে যাবে।

চর ফলকন ইউনিয়নের লুদুয়া বাজার এলাকার আবদুল করিম মিয়া কান্না জড়িত

কণ্ঠে জানান, সর্বনাশা মেঘনা নদী তার সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। বাপের ভিটে

মাটিসহ চার বার তার ঘর গ্রাস করে নিয়ে গেছে। শেষ লুধুয়া বাজার এলাকায়

এসে অন্যের জমিতে ঘর তুলে আশ্রয় নিয়ে পরিবারসহ থাকেন তিনি। এটিও যদি

নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায় কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবেন তা জানেন না তিনি।

একথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন করিম মিয়া।

উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দ্রুত নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন

করবে এমনটাই দাবি রামগতি বাজার ব্যবসায়ীসহ রামগতি ও কমলনগর

উপজেলাবাসীর।

রামগতি ও কমলনগর উপজেলার ভাঙ্গন রোধের বিষয়ে লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের

(পাউবি) নির্বাহী প্রকৌশলী গাজী ইয়ার আলী জানান, রামগতি বাজার

সংলগ্ন কোন খালে রেগুলেটর না থাকায় পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রামগতি

মাছঘাট থেকে ১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের কাজ দ্রুত শুরু করা হবে।

তিনি আরো বলেন, গত ৬ জুন নৌবাহিনীর সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে।

নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে কমলনগরের এক কিলোমিটার

বাঁধ নির্মাণ ও মতিরহাটের একটি মজসিদ ভাঙন রোধে অচিরেই কাজ শুরু হবে।

অপর ১৪ কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © banglarprotidin.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themebazarbanglaro4451