অনলাইন ডেস্ক;
বিচ্ছেদ হওয়া মা-বাবাকে একসাথে কাছে পেতে ছোট্ট দুই শিশু ধ্রুব ও লুব্ধ আদালতে যে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন সেটাকে এই সমাজের প্রতি একটা বার্তা বলেই অভিহিত করেছেন হাইকোর্ট।
রাজশাহীর মেয়ে কামরুন্নাহার মল্লিকার সাথে ছাত্রজীবনে রাজধানীতে পরিচয় হয় মাগুরার ছেলে মেহেদী হাসানের। তারপর দু’জনার প্রেম, বিয়ে। ২০০২ সালে আনুষ্ঠানিক বিয়ের পর তাদের ঘর আলোকিত করে আসে ফুটফুটে দু’টি পুত্র সন্তান।
বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করা স্বামী মেহেদীর সাথে শিক্ষিকা মল্লিকার সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। যার সমাপ্তি ঘটে বিচ্ছেদের মাধ্যমে।
স্বামী মেহেদী হাসান তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার এক সপ্তাহ আগে ছোট্ট দুই ছেলে ধ্রুব (১২) ও লুব্ধ (৯) কে তার গ্রামের বাড়ি মাগুরায় পাঠিয়ে দেন। মাগুরায় ফুফুর তত্ত্বাবধানে থাকে ধ্রুব ও লুব্ধ। এভাবেই কেটে যায় ১ বছর। তবে এই সময়ে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি বলে মা মল্লিকার অভিযোগ।
এক পর্যায়ে দুই সন্তানকে নিজ হেফাজতে নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন মল্লিকা। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে শিশু দুটিকে ২৫ জুন হাইকোর্টে হাজির করতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও শিশু দুটির বাবাকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে সন্তানদের কেন তাদের মায়ের হেফাজতে দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
আদেশ অনুযায়ী শিশু দুটিকে ২৫ জুন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে আনা হয়। এ সময় শিশু দুটির বাবা-মা, মামা, নানী ও ফুফুসহ আত্মীয়-স্বজনের আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এরপর শুরু হয় শুনানি। এক পর্যায়ে শিশু দুটির বক্তব্য শুনতে চান আদালত।
এ সময় ছোট্ট ধ্রুব বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চে বলেন, আমরা আর কিছু চাই না। আমরা বাবা-মাকে একসাথে দেখতে চাই। আমরা একসাথে থাকতে চাই।
আদালত কক্ষে নিজের ছোট্ট দুই ছেলেকে এক বছর পর কাছে পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মা কামরুন্নাহার মল্লিকা। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে দুই ছেলে।
ঠিক ওই সময় বড় ছেলে ধ্রুব আদালতে উপস্থিত তার বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে বলতে থাকে, ‘বাবা তুমি এসো, তুমি আম্মুকে স্যরি বলো। আমরা তোমাকে ও আম্মুকে নিয়ে একসাথে থাকতে চাই!’
এক পর্যায়ে এগিয়ে আসেন বাবা মেহেদী হাসান। সেসময় হাইকোর্ট কক্ষে এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়! দুই সন্তান ও বাবা-মায়ের কান্নার দৃশ্য দেখে আদালতের বিচারক-আইনজীবী ও সাংবাদিকদের চোখে জল আসে। সবাই কাঁদতে থাকেন।
বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক মা-বাবাকে উদ্দেশ্য করে তখন বলেন, এই দৃশ্য দেখেও কি আপনাদের মন গলে না? আপনারা কি এই ছোট্ট সন্তানদের জন্য নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করতে পারবেন না? সামনে তাকিয়ে দেখেন আপনাদের এই দৃশ্য দেখে সকলের চোখেই পানি আসছে।
ওইসময় আদালতে উভয় পক্ষের আইনজীবীসহ অন্যান্য আইনজীবীরা দাঁড়িয়ে সমস্বরে সন্তানদের বিষয়টি চিন্তা করতে বাবা-মার প্রতি আহবান জানান।
সেই সঙ্গে এই দুই সন্তানদের চাওয়া অনুযায়ী তাদের বাবা-মার দাম্পত্য জীবন যাতে বজায় থাকে এমন একটি আদেশের জন্য আদালতের প্রতি আহবান জানান।
এক পর্যায়ে আদালত ওই বাবা-মা এবং তাদের আইনজীবীদের খাস কামরায় ডেকে নেন। পরবর্তীতে এজলাসে এসে হাইকোর্ট বেঞ্চ তার আদেশে বলেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত শিশু দুটি তাদের মায়ের হেফাজতে থাকবে। আর এই সময়ে পিতা শিশু দুটিকে দেখতে যেতে পারবে।
এরপর আদালত এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য ৪ জুলাই দিন ধার্য করেন। সে অনুযায়ী আজ আবার দুই সন্তান নিয়ে হাইকোর্টে এসে উপস্থিত হন বাবা-মা।
এরপর শুনানি শুরু হলে আদালত দুই পক্ষের আইনজীবীর কাছে জানতে চান এই ক’দিনে ওনাদের সম্পর্কের উন্নতি কতটুক?
তখন দুই পক্ষের দুই আইনজীবী আদালতকে জানান তাদের সম্পর্ক উন্নতির দিকে। তবে আরও সময় লাগবে। এসময় স্বামীর পক্ষের আইনজীবী স্ত্রী ও দুই ছেলে সন্তানের সাথে তার বাবাকে থাকতে দেয়ার অনুমতি চান।
এসময় আদালত বলেন, তিনি থাকবেন তাতে সমস্যা নেই। আমরা চাই, বাচ্চা দুটো বাবা মার স্নেহের পরশে থাকুক। আপনারা দেখেছেন গত শুনানিতে আদালতে বাচ্চারা তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। সবাই তো এভাবে ওদের মত বলতে পারে না। ওরা আসলে এই সমাজে বিচ্ছেদ হওয়া পরিবারের সন্তানদের মনের অব্যক্ত অনুভূতি সেদিন তুলে ধরেছে। যেটা একটা মেসেজ।
এসময় স্বামীর পক্ষের আইনজীবী বলেন, মাই লর্ড। কয়েকদিন আগে লুব্ধর বাবা তার মায়ের বাসায় রাতে থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাকে এ্যালাউ করা হয়নি। এতে ছোট ছেলেটির মন খারাপ করেছিল। তখন আদালত আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ওয়েট। এভরিথিং হ্যাপেন্ড অটোমেটিক্যালি।’
এরপর আদালত শিশু ধ্রুব ও লুব্ধকে এজলাসের সামনে ডাকেন। ওরা এগিয়ে গেলে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, কেমন আছো তোমরা? আব্বু বাসায় যায়? উত্তরে দুই শিশু জানায়, ভাল আছি। হ্যাঁ, আব্বু বাসায় আসেন।
বিচারপতি এবার ধ্রুব ও লুব্ধর কাছে জানতে চান তারা বিশ্বকাপে কে কোন দল সাপোর্ট করে। উত্তরে ধ্রুব জানায়, সে ব্রাজিলের সাপোর্টার আর লুব্ধ বলে সে আর্জেন্টিনা ।
অবশেষে আদালত ধ্রুব- লুব্ধ’র মা বাবকে সামনে ডাকেন। তারা এগিয়ে আসলে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, আপনাদের এই বিষয়টি মিডিয়ায় এসেছে। আপনারা উচ্চ শিক্ষিত মানুষ। সবাই কিন্তু আপনাদের সিদ্ধান্তের দিকে তাকি আছে। আপনাদের এই বিষয়টি বুঝতে হবে। আপনাদের একটি সিদ্ধান্ত সমাজের প্রতি উদাহরণ হয়ে থাকবে।
এরপর আদালত এবিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য ১ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন।
আদালতে শিশু দুটির বাবার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তাপস কান্তি বল। আর মায়ের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।