বাংলার প্রতিদিন নিউজ ডেস্কঃ
বিনম্র শ্রদ্ধার ফুল আর স্বজন-সহকর্মীদের চোখের জলে স্মরণ করা হলো ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নৃসংশতম জঙ্গি হামলায় নিহতদের।
রোববার ভয়াবহ ওই হামলার দ্বিতীয় বর্ষে রক্তস্নাত সেই হলি আর্টিজান রেস্তোরা চত্বরে তৈরি অস্থায়ী বেদীতে পরম মমতা ও ভালোবাসায় বিনম্র শ্রদ্ধা জানান রাজনৈতিক দলের নেতা, বিদেশি কূটনীতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মী, নারী-শিশুসহ নানা পেশার মানুষ।
২০১৬ সালের ১ জুলাই নৃশংসতম হামলায় দেশি-বিদেশিসহ ২২ জন নিহত হন। নিহতদের একজন ইতালির নাগরিক নাদিয়া বেনেদিত্তি। তিনি একজন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা ছিলেন।
জঙ্গিরা এই বিদেশির প্রাণ কেড়ে নিলেও এদেশে তার উদ্যোগে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও সচল। হামলার দ্বিতীয় বর্ষে অস্থায়ী বেদীতে অনেকের সঙ্গে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তার প্রতিষ্ঠান স্টুডিওটেপ’র কর্মীরা।
প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র ম্যানেজার ওয়াহিদুল আলম চোখ মুছতে মুছতে বলছিলেন, এ দেশের মানুষের প্রতি বেনেদিত্তির গভীর ভালোবাসা ছিল। কর্মক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অসীম অনুপ্রেরণা। তার শুন্যস্থান কখনোই পূরণ হওয়ার নয়।
চোখের জল নিয়েই বেদীতে ফুল দেন অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত বনানী থানার তৎকালীন ওসি সালাউদ্দিন খানের বড় ভাই রাজি উদ্দিন খান। তিনি বলেন, মানুষের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে তার ভাই জীবন দিয়েছেন। এতে তারা গর্ববোধ করেন।
এর আগে সূর্য উঠার পর সকাল সাড়ে ৬ টার দিকে বেদীতে ফুল দেন ঢাকাস্থ জাপনি রাষ্ট্রদূত হিরোইসু ইজুমি ও দূতাবাসের কর্মকর্তারা। তারা নিরবে দাঁড়িয়ে থেকে জাপানি সাত নাগরিকসহ অপর নিহতদের স্মরণ করেন। এরপরই ইতালি দূতাবাসের কর্মকর্তারা, ঢাকায় বিভিন্ন দূতাবাস, মিশন ও বিদেশী উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ওই সময় তারা ছিলেন নির্বাক।
হামলার পর ঘিরে রাখা হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ চত্বরের ফটক সবার শ্রদ্ধা জানাতে রোববার সকাল ১০টার দিকে চার ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়া হয়। এরপর সেখানে আওয়ামী লীগের পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জঙ্গিবাদের সমস্যা মোকাবিলা করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব সময় সতর্ক রয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে তারা সক্ষম। সরকার এই জঙ্গিবাদের সমস্যা সমাধানে আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি দলীয়ভাবে রাজনৈতিকভাবেও মোকাবেলা করছে।
শ্রদ্ধা জানাতে যায় বিএনপির একটি প্রতিনিধি দলও। দলটির ভাইস চেয়ারম্যান রুহুল আলম চৌধুরীরে নেতৃত্বে তারা অস্থায়ী বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ওই সময় বিএনপির মিডিয়া উইংয়ের সদস্য সায়রুল কবির খান উপস্থিতিত ছিলেন।
বিএনপি নেতা রুহুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘নৃসংশ জঘন্য হত্যাকাণ্ড যেটা হয়েছিল, যেটা শুধু বাংলাদেশই নয় পুরো বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। সেই ঘটনার দুই বছরপূর্তি পালন করা হলেও এখন পর্যন্ত ঘটনার তদন্ত শেষ হয়নি, বিচারকার্য শুরু করতে পারেনি।’
র্যাবের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে সশ্রদ্ধ সালাম জানান সংস্থাটির মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। এরপর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গত দুই বছরের জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মাধ্যমে আমরা সারা বিশ্বকে সিগনাল দিতে সক্ষম হয়েছি যে, বাংলাদেশ জঙ্গিদের নিরাপদ আশ্রয় নয়। বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গিবাদ বরদাস্ত করবে না।
র্যাব মহাপরিচালক বলেন, এখনো আত্মতুষ্টির কোনো কারণ নেই। কারণ জঙ্গিবাদ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সম্পূর্ণ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে যেতে হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও নিহতদের স্মরণ করা হয়। ওই সময় ডিএমপি কমিশনার ছাড়াও অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) দেবদাস ভট্টাচার্য, কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পরে পুলিশ কর্মকর্তারা গুলশান পুরাতন থানার সামনে স্থাপিত ‘দৃপ্তশপথ’ ভাস্কার্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। হলি আর্টিজানে হামলার পর জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে নিহত পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও ওসি সালাউদ্দিন খানের স্মরণে ওই ভাস্কার্য নির্মাণ করা হয়।
হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন রেস্তোরাঁটির ডিশ ক্লিনার জাকির হোসেন শাওন। পরে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। রোববার হলি আর্টিসান চত্বরে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে এসেছিলেন শাওনের মা মাকসুদা বেগম। তিনি ছেলের একটি ছবি বুকে নিয়ে বিলাপ করছিলেন। তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে জানিয়ে এর বিচার চাচ্ছিলেন এই মা।
এ ছাড়া অস্থায়ী বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান গুলশান, বনানী ও বাড্ডা থানার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা। আরও শ্রদ্ধা জানায় স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠন।
২০১৬ সালের ওই জঙ্গি হামলা ও পরে কমাণ্ডো অভিযানের পর তছনছ অবস্থায় ছিল হলি আর্টিসান বেকারি। দেয়ালে ছিল গুলির চিহ্ন, মেঝেতে রক্তের দাগ। আসবাবপত্র ছিল এলোমেলো।
তবে রোববার ওই নৃশংস হামলার দুই বছর পর ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় সেই ধকল কাটিয়ে উঠেছেন ভবন মালিক। হামলার পর সেখানে আর রেস্তোরাঁ চালু না হলেও হামলায় ক্ষতবিক্ষত বাড়িটি বসবাসের উপযোগী করা হয়েছে। তবে এখনও সেখানে কেউ থাকেন না।