বৈশ্বিক পুঁজিবাদের দুটি ধারা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই বিকশিত হয়েছে। এই বিকাশের পথে তাদের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া কখনো বন্ধ হয়নি। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা যেমন তাদের টিকিয়ে রেখেছে, তেমনি প্রতিযোগিতার দরুন নতুন নতুন পথে হাঁটার মন্ত্রও দিয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে যে, বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদের দুটি ধারার একটির নেতৃত্বে রয়েছে চীন, অন্যটির যুক্তরাষ্ট্র। একটি কাঠামো উচ্চ প্রবৃদ্ধির অজুহাতে নিয়ন্ত্রিত পুঁজির ব্যবস্থাপত্র হাজির করে। অন্যটি আপাত নিরীহ নাগরিক অধিকারগুলোকে প্রশ্রয় দিতে উদারবাদী খোলসটি গায়ে চাপিয়ে নেয়। যদিও বৈষম্য উৎপাদনে দুটি ব্যবস্থাই সমানভাবে সফল। এ ক্ষেত্রে মেধার বিকাশ, সুযোগের সাম্যসহ যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারার নানা প্রতিশ্রুতি যেমন কাজে আসে না, তেমনি ‘সবার বিকাশ’ আপ্তবাক্যকে সামনে রেখে চীনের নামে কমিউনিজমের খোলসটিও তেমন বৈষম্য-নিরোধক নয়। ফলে দুই কাঠামোই প্রতিযোগিতা করেই বাড়িয়ে চলে শতকোটিপতির (বিলিওনিয়ার) উৎপাদন।
১৯৭৮ সালে চীনের অর্থনৈতিক উৎপাদনের শতভাগই ছিল সরকারি খাতে, যা বর্তমানে ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে বলে জানাচ্ছে গবেষণা পত্রিকা ফরেন অ্যাফেয়ার্স। পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোর মতোই চীনের উৎপাদন ব্যবস্থার মালিকানা মুখ্যত বেসরকারি হাতে। রাষ্ট্র ব্যক্তিমালিকানাধীন এসব প্রতিষ্ঠানে নাক গলায় না। পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে এর মূল্য নির্ধারণ, শ্রমিকদের মজুরি ইত্যাদি কোনো ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র নাক গলায় না। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পুঁজি কাঠামো বা রাজনৈতিক পুঁজিবাদ জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ চীন। এ কাঠামো নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর অংশ হিসেবে রাজনীতিকদের হাতে বড় ধরনের ক্ষমতা তুলে দেয়। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে দেয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। যদিও ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয় না।
১৯৪৯ সালে বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো অনুসরণ করেই চলছিল চীন। কিন্তু আরেক সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়ার সঙ্গে ষাটের দশকে সৃষ্ট বিরোধ তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেকটা একলা করে দেয়। সমাজতন্ত্রের এ দুই ঘরানার দ্বন্দ্বটি বিস্তার পেয়েছিল অন্য দেশগুলোতেও, যা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাদের বিকল্প হিসেবে কমিউনিজমের অগ্রযাত্রায় এক বিরাট ছেদ টেনে দেয়। সে অন্য আলাপ।
পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক কাঠামো থেকে চীনের সরে আসার সূচনাটি হয়েছিল ১৯৭৮ সালেই। দুর্ভিক্ষসহ নানা দুর্দশার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ওই বছর প্রথম দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির নেতার দেং জিয়াওপিং অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। এর পরের বছরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে তিনি একটি চুক্তিতে উপনীত হন, যার অবধারিত ফল হিসেবে বেসরকারি মালিকানায় ব্যবসার দ্বার উন্মুক্ত হয়। ওই বছর চীনা উপকূলে চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয় বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য। মজার বিষয় হচ্ছে, এর পরের বছর থেকেই চীনে আয় ও সম্পদ বৈষম্য বাড়তে শুরু করে। ১৯৮০-এর দশকে শুরু হওয়া এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ২০০৮ সালে সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়। ওই সময় নেওয়া কিছু সচেতন প্রয়াসের কারণে তা বর্তমানে কিছুটা কমে এলেও, এখনো এ বৈষম্য অনেক বেশি।
মোদ্দাকথা হচ্ছে, সাধারণ মানুষকে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল পাইয়ে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চীন নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের তত্ত্বটি হাজির করে, তা যে কাজ করছে না—সে কথা বলাই বরং অবান্তর। একইভাবে যে সমসুযোগ ও নাগরিক অধিকারের কথা বলে পুঁজিবাদের গায়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটি উদারবাদী চাদরটি জড়ায়, তাও আদতে একটি ভাঁওতা। কারণ, গত ৫০ বছরে দেশটিতে অর্থনৈতিক বৈষম্যের হার বর্তমানে সর্বোচ্চ। আমেরিকান কমিউনিটি সার্ভে রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে।
পুঁজির এ দুই কাঠামোর দ্বন্দ্বটি স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতি থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরেই বিস্তৃত হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো বহু আগে থেকেই বলে আসছে যে, পুঁজিবাদী কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে হলে এবং একে সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু চীনের সাফল্য তাদের দাবিকে অসার প্রমাণ করেছে। একই সঙ্গে গণতন্ত্র ও ন্যায্যতার কথা বললেও অসাম্যের চূড়ান্ত উদাহরণ স্থাপন করে নিজের কপালে নিজেই প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে ব্যবস্থাটি। প্রশ্ন উঠেছে এর কথিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধটি নিয়েও। এরই ফল হিসেবে বিশ্বমঞ্চে ডোনাল্ড ট্রাম্প, বরিস জনসন, জায়ের বোলসোনারো, নরেন্দ্র মোদির মতো নেতাদের উত্থান হচ্ছে। এই উত্থান আবার ‘নাগরিক অধিকার’ নামের উদারবাদী পুঁজিবাদী কাঠামোর সবচেয়ে গৌরবের ও প্রদর্শনযোগ্য বস্তুটিকে ম্লান করে দিচ্ছে। ফলে নিয়ন্ত্রিত পুঁজি ব্যবস্থার পশ্চিমা সমালোচনাটিও আর খাটছে না।
আবার নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী কাঠামো নাগরিকদের কাছ থেকে অধিকার বন্ধক চাওয়ার বদলে যে উচ্চ প্রবৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, তাও তার পক্ষে রক্ষা করা সব সময় সম্ভব হয় না। অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, আমলাতন্ত্রসহ নানা সংকট তাকে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলতে থাকে। বর্তমান সময়ে উদারবাদী পুঁজির বিপরীতে এই কাঠামোটি বেশি সফল হলেও তা ধরে রাখার বিষয়টি নির্ভর করছে অতি ধনাঢ্য শ্রেণির বিকাশ ও তার ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কৌশলের ওপর। চীনে বর্তমানে তিন শতাধিক শতকোটিপতি রয়েছেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন ছয় শতাধিক। এই হিসাবই বলে দেয়, ব্যক্তিগত মালিকানার বিষয়টি অনেক দেরিতে শিথিল করলেও চীন এ ক্ষেত্রে কত দ্রুত এগিয়ে গেছে। ফলে, এই অতি ধনীদের কাছ থেকে চীনের রাজনৈতিক নেতারা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। চীনের সামনে এই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের লড়াইটিকে তাই নিছক ভূরাজনৈতিক লড়াই হিসেবে না দেখে বাণিজ্যযুদ্ধের সময় যে, ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল, তা-ই বলা যায় যথার্থ। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে হওয়া স্নায়ুযুদ্ধ থেকে এটি সব প্রকরণেই অবশ্য আলাদা। কারণ, আগেরটি ছিল দুটি মতবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত। বর্তমানটি একই মতবাদের দুটি ধারার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের রেশ ধরে উভয় পক্ষই নতুন করে দল ভারী করতে নেমেছে বৈশ্বিক মঞ্চে। এক পক্ষ যখন নানা ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উদ্যোগের জন্ম দিচ্ছে, অন্য পক্ষ তখন নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন পুরোনো সংস্থা ও উদ্যোগগুলোকে ঢেলে সাজাতে তৎপর। চীনের বিআরআই থেকে শুরু করে নানা উদ্যোগ এবং ন্যাটোর সর্বশেষ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এ প্রবণতার স্বাক্ষর বহন করছে। বিভিন্ন দেশকে নিজ দলে টানার ক্ষেত্রে চীন ব্যবহার করছে তার উচ্চ প্রবৃদ্ধির ব্যবস্থাপত্রকে। আর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব এখনো ব্যবহার করছে উদারবাদী গণতন্ত্রকে। এ লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কে জিতবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে লড়াইটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর জয়-পরাজয়ই ঠিক করে দেবে ভবিষ্যৎ বিশ্বের মেরুকরণের গন্তব্য।
পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে এ লড়াইয়ে চীন অনেকটাই এগিয়ে গেছে বলে মনে হয়। ফরেন পলিসি জানাচ্ছে, ১৯৭০ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উৎপাদনের ৫৬ শতাংশই আসত ইউরোপ থেকে। একই সময়ে এ ক্ষেত্রে এশিয়ার অবদান ছিল মাত্র ১৯ শতাংশ। বর্তমানে এ হার যথাক্রমে ৩৭ ও ৪৩ শতাংশ। এশিয়ার এই উল্লম্ফনে অবশ্য পশ্চিমা গণতন্ত্রের নীতির অনুসারী ভারতের অবদান একেবারে কম নয়। অর্থাৎ পরিসংখ্যান হেলে আছে এশিয়ার দিকেই। আবার পশ্চিমের গণতান্ত্রিক খোলসের নিচে চাপা থাকা কট্টরবাদী কঙ্কালটিও নানা লোকরঞ্জনবাদী রাষ্ট্রনেতার মাধ্যমে প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতির মেরুটি আবার বদল হবে, নাকি একাধিক মেরুর উত্থান হবে, তা সময়ই বলে দেবে।