শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০৬ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

রাজীবের দখলে ছিল ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড পুরোটাই

অনলাইন ডেস্কঃ
  • আপডেট সময় সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৯
  • ৩১৮ বার পড়া হয়েছে

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে মসজিদ কমিটি, বাজার কমিটি থেকে শুরু করে ফুটপাত, বাসস্ট্যান্ড—সবই ছিল কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান ওরফে রাজীব ও তাঁর অনুসারীদের দখলে। মানুষের জায়গাজমি, ফ্ল্যাটও তাঁরা দখল করে নিতেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার মদদে পুরো এলাকায় ছিল রাজীবের একচ্ছত্র আধিপত্য।

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজির অভিযোগে গত শনিবার রাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে রাজীবকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। পরে মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটিতে তাঁর বাসায় অভিযান চালায় র‍্যাব। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় র‍্যাব পুলিশের কাছে রাজীবকে তুলে দেয়। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা করেছেন র‍্যাবের উপসহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান।

গতকাল রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজীবকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে পুলিশ হাজির করে ২০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে। মধ্যরাতে উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত দুই মামলায় সাত দিন করে ১৪ দিন রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন।

রাজীব ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শনিবার রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়।

গতকাল দুপুর ১২টায় মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বছিলা যাওয়ার সড়কে রাজীবের শাস্তি চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন কয়েক শ এলাকাবাসী। তাঁদের অনেকেই ছিলেন রাজীব ও তাঁর অনুসারীদের হাতে নির্যাতনের শিকার। কারও জায়গা, কারও-বা ফ্ল্যাট দখল করে নিয়েছেন রাজীব ও তাঁর অনুসারীরা।

শনিবার রাতে রাজীবকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব
রোববার মধ্যরাতে আদালতে শুনানি হয়।
অস্ত্র ও মাদক মামলায় রাজীব ১৪ দিনের রিমান্ডে।

গতকাল দুপুরে মোহাম্মদপুরে রাজীবের বাসায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। দোতলা বাসাটি উঁচু দেয়ালে ঘেরা। দেয়ালের ওপর আবার কাঁটাতারের কুণ্ডলী রয়েছে। বাসার দারোয়ান মোশাররফ জানান, বাসায় রাজীব তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানকে নিয়ে থাকতেন। বাসায় তল্লাশি করার জন্য রাজীবকে সঙ্গে নিয়ে শনিবার রাতে র‍্যাব এসেছিল। তল্লাশি শেষে ভোরে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। স্ত্রী ও সন্তান বাসায় নেই।

রাজমিস্ত্রি বাবার সন্তান রাজীবের উত্থান কাছ থেকে দেখেছেন মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি আবুল মিয়া। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পরিবারের সঙ্গে রাজীব মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ের একটি টিনের ছাউনির ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাজীব এই বাজারেই চায়ের দোকানে কাজ করতেন। এরপর তৎকালীন মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মারুফ হোসেন ওরফে বিপ্লবের হাত ধরে সংগঠনটির রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ২০১৪ সালের দিকে তিনি ঘনিষ্ঠ হন তখনকার স্থানীয় সাংসদ জাহাঙ্গীর কবির নানকের। এরপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

আবুল মিয়া ছাড়াও রাজীবের উত্থান এবং তাঁকে পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়ে জাহাঙ্গীর কবির নানকের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি মেহাম্মদপুর এলাকার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একাধিক নেতা জানিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কারও উত্থান বা পতনের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা নেই। স্থানীয় সাংসদ হিসেবে দল-মতনির্বিশেষে সবার সঙ্গেই তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিল। কাউন্সিলর নির্বাচনে তাঁরই মদদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে রাজীব নির্বাচন করেছিলেন, এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে আমি কখনো নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করিনি।’

স্থানীয় ব্যবসায়ী আবুল মিয়া আরও বলেন, কাউন্সিলর হওয়ার পরপরই রাজীব পুরো এলাকা তাঁর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। পুলিশ ও সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে নিয়ে তিনি একদিন মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি কাঁচাবাজারও দখলে নেন। নিজের অনুসারীদের দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন। বাজারের ৪ দশমিক ৯ শতাংশ জায়গা দখলে নিয়ে তাঁর এক অনুসারী বাড়ি বানানোর কাজ শুরু করেন। সেই নির্মাণকাজ এখনো চলছে।

একই অভিযোগ করেন কাটাসুর কাঁচাবাজার বহুমুখী সমবায় সমিতির সাবেক নেতারাও। তাঁরা জানান, বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই চাঁদাবাজি শুরু করেন রাজীব ও তাঁর অনুসারীরা। এই বাজারে ১৬০টি দোকান রয়েছে। উন্নয়নের নাম করে প্রতি দোকান থেকে দুই দফায় ৬২ হাজার টাকা করে নেন তাঁরা। কিন্তু কোনো উন্নয়নকাজই করা হয়নি। বাজারের পাশে পৌনে দুই কাঠা জায়গা কেনার জন্য দোকানদারদের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা করে প্রায় দুই কোটি টাকা নেওয়া হয়। সেই জায়গাও এখনো পাওয়া যায়নি।

মোহাম্মদপুর বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ডের ঠিক কাছেই রয়েছে আল্লাহ করিম জামে মসজিদ। ৪৫ শতাংশ জায়গার ওপর নির্মিত এই মসজিদের প্রতিষ্ঠা ১৯৬০ সালে। মসজিদ-সংলগ্ন মার্কেটে রয়েছে ১০৩টি দোকান। কাউন্সিলর হওয়ার পরপরই রাজীব এই মসজিদের দোকান দখলে নিয়ে নেন। প্রথমে তাঁর ভগ্নিপতিকে মসজিদ কমিটির সভাপতি বানান। কিছুদিন পর তিনি নিজেই সেই দায়িত্ব নেন।

মসজিদ কমিটির সাবেক নেতারা বলছেন, মসজিদ কমিটি দখলে নিয়ে একে ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত করেন রাজীব ও তাঁর অনুসারীরা। মো. মোকাররম হোসেন নামের এক সাবেক সদস্য বলেন, একদিন দলবল নিয়ে মসজিদে এসে পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। তৎকালীন কমিটির লোকজনের কক্ষে তালা লাগিয়ে দেন। মসজিদের চতুর্থ তলার ছাদের একাংশ নির্মাণের জন্য আলমারিতে পাঁচ লাখ টাকা রাখা ছিল। সেই টাকাও নিয়ে যান। কিন্তু গত চার বছরেও সেই ছাদের নির্মাণকাজ শেষ হয়নি।

মোকাররম হোসেন বলেন, মসজিদে প্রতি শুক্রবার ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা মুসল্লিদের দান থেকে আসে। সেই টাকার পুরোটাই নিয়ে যান রাজীবের অনুসারীরা। এমনকি ঈদের সময় কমিটির সদস্যরা মসজিদের তহবিল থেকে ২৫ হাজার টাকা করেও নিয়েছেন। মসজিদের চারপাশের ফুটপাতে দোকান বসিয়ে সেখান থেকে প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা চাঁদা নেন রাজীব ও তাঁর অনুসারীরা।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ, চন্দ্রিমা হাউজিং, সাতমসজিদ হাউজিং, ঢাকা উদ্যানসহ বিভিন্ন এলাকায় দখলবাজি ও চাঁদাবাজি করেই মূলত অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন রাজীব। তিনি ও তাঁর অনুসারীরা জোরপূর্বক বিভিন্ন মানুষের বাড়ি এবং ফ্ল্যাট দখল করে নিয়েছেন। মোহাম্মদপুরের সাতমসজিদ হাউজিংয়ের সভাপতি বদরুল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের হাউজিংয়ের ১১টি বাড়ি দখল করে নেন রাজীব ও তাঁর অনুসারীরা। এ নিয়ে কারও কাছে অভিযোগ করার সাহসও ছিল না কারও।

আরও সংবাদ

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © banglarprotidin.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themebazarbanglaro4451