শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:০০ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা শামসুল হকের স্মৃতি কথা

বাংলার প্রতিদিন ডেস্ক ::
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৯
  • ৩১০ বার পড়া হয়েছে

সাইফুর রহমান শামীম,কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি : মুক্তিযোদ্ধা মো.
শামসুল হক। অনেক স্বপ্ন নিয়ে সম্মুক যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন।
স্বাধীনতার মাসে তার যুদ্ধকালিন অভিজ্ঞতা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এবং স্বপ্ন
নিয়ে কথা বলেছেন
১. আমরা স্বাধীনতার ৪৬ বছর অতিক্রম করেছি। আজো আমাদের স্বপ্ন পূরণ
হয়নি। কারণ, স্বাধীনতার পরই আমরা নানাজন নানা মতে ও পথে বিভক্ত হয়ে
পড়েছি। দেশমাতৃকার স্বার্থে এক হতে পারিনি। কিন্তু এখনো সময়
ফুরিয়ে যায়নি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে পুরো জাতি যেমন
এক হয়েছিল তেমনই আবারো এক হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
আর এ দায়িত্ব পালন করতে হবে নতুন প্রজন্মকে। নতুন প্রজন্মের কাছে
আমাদের প্রত্যাশাও অনেক। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের ভাষণ শুনে মুক্তিকামী
জনতার সারিতে দাঁড়িয়ে আমিও পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে
যুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমি চাকরি করতাম যশোর জেলার, মোবারকগঞ্জ সুগার
মিলে। সেই সময়ে যশোর সেনানিবাস থেকে সুগার মিলের আশপাশে
শীতকালীন মহড়ায় আসা আমার পরিচিত এক বাঙালি সেনা গোপনে
আমাকে জানিয়ে দিলেন, পারলে দ্রুত বাড়ি চলে যাও, অবস্থা ভালো না। ১
এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে যশোর-ঢাকা রোডে পাক বাহিনী গুলি চালিয়ে
রাস্তার সাধারণ মানুষ মেরে সামনে ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়ার দিকে এগিয়ে
যেতে থাকে। পাকসেনার গাড়ি চলে গেলে দেখা যায়, রাস্তার পাশে অনেক
সাধারণ মানুষের লাশ পড়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে বাঙালিরা আরো জাগ্রত
হয়। অস্ত্র নিয়ে যশোর সেনানিবাস থেকে বাঙালি সেনারা বেরিয়ে এসে
স্থানীয় যুবকদের নিয়ে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। তারা
রাস্তায় ব্যারিকেট দিয়ে সুকৌশলে অনেক পাকসেনাকে পাকড়াও করে মেরে
ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের জন্য আমি এবং নুর আলী বিশ্বাসসহ
সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের নিয়ে বাসায় বাসায় ঘুরে রুটি চিরা গুড়
সংগ্রহ করি। এভাবে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত কঠিন অসুবিধার মধ্যেও সুগার
মিলে ছিলাম। প্রতিদিন বিবিসির খবর শুনে অবস্থা অবগত হতাম আর বাহিরে
দেখতাম মিলের পাশ দিয়ে কিভাবে বাঙালিরা স্বজনদের নিয়ে বন্ধু রাষ্ট্রে চলে
যাচ্ছে শরণার্থী হয়ে। নিকটতম সব কর্মকর্তা শ্রমিক/কর্মচারী সুগার
মিল ছেড়ে বাড়িতে চলে গেছে। আমি একা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ি।
২. আমার বাড়ি রংপুরের শেষ প্রান্ত ভুরুঙ্গামারীতে। নুর আলী বিশ্বাস
আমাকে সাহস দিয়ে বলেন, চলুন মেহেরপুরে যাই। ১৭ এপ্রিল সকালে
মেহেরপুরে পৌঁছি। সেখানে গিয়ে দেখি মেহেরপুরের আমবাগানে
মুজিব নগর সরকার গঠনের প্রস্তুতি চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যে শপথ গ্রহণ শুরু

হবে। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপদেশমূলক ভাষণ এবং নির্দেশাবলি শুনি। শপথ
অনুষ্ঠান শেষে সুগারমিলে ফেরত চলে আসি।
১৯ এপ্রিল আমি শরণার্থীদের সাথে হেঁটে বাগদা সীমান্ত পার হয়ে
বনগাঁ গিয়ে মাগুরার ছোহরাব হোসেন এবং যশোরের রওশন আলীর নিকট
থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে বনগাঁ থেকে ট্রেনে কলকাতায় যাই। যাওয়ার পথে
ট্রেনে এক মহিলা যাত্রী আমাকে দেখে রাগ করে বলেন, আপনারা যুবক
ছেলেরা জয় বাংলা ছেড়ে চলে আসছেন কেন? মুক্তিযুদ্ধে যান। আমরা সম্ভম
হারিয়ে এসেছি। উনার কথায় আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি।
এরপর কলকাতায় গিয়ে হাওরা স্টেশন থেকে জলপাইগুড়িগামী ট্রেনে উঠে
কুচবিহারের উদ্দেশে রওনা হলাম। এরপর কুচবিহার পৌঁছে সেখান থেকে
বাসে করে দিনহাটা হয়ে সাহেবগঞ্জ নেমে হেঁটে বিকাল ৫টায় মুক্ত
এলাকা ভুরঙ্গামারী পৌঁছি। জামতলায় জব্বার মিয়ার চায়ের দোকানের
সামনে শামসুল হক চৌধুরী এমপি, পেটলা মজিবর রহমান, ফজলার রহমান,
আব্দুল জলিল সরকার, জয়নাল মিয়া, ডা. নিয়ামত আলী, আব্দুল মান্নান,
কাদের ব্যাপারী, ফনী ভুষণ সাহা, আক্তার মন্ডল, ইসহাক ব্যাপারী, তমিজ মাস্টার,
মধু মাস্টার, হাকিম শিকদারসহ আরো অনেককে মিটিং করতে দেখতে পাই।
শামসুল হক চৌধুরী আমাকে দেখে চিৎকার করে কাছে ডেকে বললেন, তুই
কেমন করে আসলি? ঐদিকের খবর বল। আমি বিস্তারিত ঘটনা খুলে বললাম।
তিনি আমাকে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের সাথে কাজ করার নির্দেশ দিলেন।
৩. পরের দিন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের সাথে দেখা করি। তার নির্দেশক্রমে প্রথম
দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের যাতায়াত ও খাবার ব্যবস্থার জন্য ফায়ার সার্ভিসের
একটি পিকআপ ভ্যান নিয়ে আসামের গোলকগঞ্জ থেকে পেট্রোল এবং
জয়মনিরহাট, নাগেশ্বরীর খাদ্যগুদাম থেকে চাল সংগ্রহ করে এনে সিও
অফিসে ক্যাপ্টেনের কাছে রাখতে শুরু করি। এছাড়া উত্তর ধরলামুক্ত থাকার
সময়ে নাগেশ্বরীর আওয়ামী লীগের সংগঠক শেখ মজিবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডা.
ওয়াশেক আহম্মেদ ও ভুরুঙ্গামারীর মজিবুর রহমানের সাথে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে
বিভিন্ন সলাপরামর্শ করি। কুড়িগ্রাম পাকবাহিনীর দখলে চলে গেলে উত্তর
ধরলামুক্ত রাখার জন্য আমাদের জোয়ানরা বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে
তোলে। কিন্তু বেশি দিন মুক্ত রাখা সম্ভব হয়নি। এরপর ঊর্ধ্বতন সংগঠকদের
নির্দেশে আমরা ভারতের বর্ডারে চলে যাই। কুচবিহার ৬নং সেক্টরের জোনাল
অ্যাডমিনিসট্রেটর মতিউর রহমানের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা নেই।
সাহেবগঞ্জে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের ৬নং সেক্টরের ‘সাব সেক্টর’ অফিস চালু
করি। এরপর নাজিরহাটে ঝন্টু মিয়ার জমিতে ‘যুব শিবির’ তৈরি করি।
নাজিরহাট যুব শিবিরে প্রতিদিন ৪০/৫০ জন যুবক ভর্তি হতে থাকেন।
এদের খাওয়া, যাতায়াতসহ সব কিছু আমাকে দেখতে হয়েছে। ২/৩ দিন
শিবিরে রেখে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে দিনহাটায় শিবিরে পাঠানো
হতো। সেখান থেকে ভারতের সহায়তায় সামরিক ট্রেনিংয়ের জন্য বিভিন্ন
জায়গায় নিয়ে যেতো।

৪. দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের কতো করুণ স্মৃতি/ইতিহাস মনের ভেতরে আছে
তা ভাষায় বোঝানো কঠিন। ক্লান্তি বলে শরীর থেমে থাকেনি। যখন যেখানে
ডাক পড়েছে ছুটে গেছি। ভুরঙ্গামারী পাকবাহিনী দখলে থাকা অবস্থায়
গেরিলা কায়দায় কয়েক রাত্রি ভুরঙ্গামারী এসেছি। কিন্তু নিজের বাড়ি
খুঁজে পাইনি। রাজাকাররা আমাদের বাড়ি ঘর সব পুড়িয়ে এবং গাছপালা
কেটে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭১ সালে ১৪ নভেম্বর ভুরঙ্গামারী
হানাদার মুক্ত হলে পরিবারের লোকজন নিয়ে ভারত থেকে নিজ ভূমিতে ফিরে
আসি। খোলা আকাশের নিচে অনেক দিন তাঁবু খাটিয়ে থাকতে হয়েছে।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দীর্ঘ ৯ মাসের দুঃখ বেদনা ভুলে আমরা
আনন্দে মেতে উঠি। এরপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ২৭ ডিসেম্বর
মোবরকগঞ্জ সুগার মিলে পৌঁছে আবার কর্মে যোগ দেই। যারা ঐ সময়ে
সুগার মিলে ছিলেন তারা আমাকে দেখে চিৎকার দিয়ে বলে উঠেন
আপনাকে নাকি বর্ডার পার হওয়ার সময় খান সেনারা মেরে ফেলেছে। আপনার
মৃত্যুর সংবাদে আমরা শোক সভা, গায়েবি জানাজা এবং মসজিদে দোয়া
মাহফিল করেছি এই আপনার ভাগ্য
এতো সংগ্রাম এবং কষ্টের বিজয়কে ফলপ্রসূ করার জন্য স্বাধীনতার মাসে
এই নতুন প্রজন্মের কাছে আমার বিনীত আরজ আমরা বাঙালি বীরের জাতি।
আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নিচু করবে না। শেখ মজিবুর রহমানের ৭
মার্চের ভাষণের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে বীর বাঙালি দলমত নির্বিশেষে এক
জোট হয়ে মাত্র ৯ মাসেই একটি দেশ স্বাধীন করেছি। বিশ্বের ইতিহাসে
এমন সাহসিক বিজয়ের নজির নেই। সব ভেদাভেদ ভুলে সবাই এক জোট হয়ে
বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে সুখী সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করো।##

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © banglarprotidin.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themebazarbanglaro4451